স্পোর্টস ডেস্ক: [২] পারিশ্রমিক বলতে ছিল মাত্র কয়েকশো টাকা। স্থানীয় ম্যাচে ক্রিকেট খেলার সুবাদে ওই সামান্য কিছু অর্থই আসত ঘরে। এদিকে ছেলের ক্রিকেট খেলার ‘বিলাসিতা’ বজায় রাখতে গিয়ে নাভিশ্বাস অটোচালক বাবার পরিবারে।
[৩] ছেলেকে ক্রিকেট ছাড়ানোর জন্য একসময় প্রাণপণ চেষ্টা করে গিয়েছেন মোহাম্মদ সিরাজের বাবা-মা। কিন্তু যতই তিরস্কৃত হয়েছেন, ততই যেন ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরেছেন ভারতের এই নতুন ডানহাতি পেসার। অভাবের সংসারে অবলম্বন করেছেন ক্রিকেটকেই। পরে অবশ্য ছেলের স্বপ্নপূরণে প্রাণপাত পরিশ্রম করেন সিরাজের বাবা।
[৪] ক্রিকেটও অবশ্য দুহাত ভরিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। ক্রিকেটের হাত ধরেই এসেছে যশ, খ্যাতি ও অর্থ। ৩ বছর আগে আইপিএল নিলামের শিরোনামে ছিলেন সিরাজ। ২০ লাখ টাকা বেসপ্রাইজ থাকা সিরাজকে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকায় কিনে নেয় সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। আইপিএল নিলামের হাত ধরে অটোচালকের সন্তানের ক্রিকেটের গলি থেকে রাজপথে উঠে আসার কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত।
[৫] ১৯৯৪ সালের ১৩ মার্চ হায়দরাবাদে জন্ম সিরাজের। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ ২০১৫ সালে। সে বছর হায়দরাবাদের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে খেলেন তিনি। পরের বছর রঞ্জিতে তিনিই ছিলেন হাদরাবাদের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রথম সুযোগ টেস্ট দলে। কিন্তু সে বার একটি টেস্টেও খেলা হয়নি তার। ওয়ানডে ম্যাচে অভিষেক ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম একদিনের ম্যাচে খেলেন তিনি। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাও ছিল টি-২০ অভিষেকের মতোই তিক্ত।
[৬] একদিন হায়দরাবাদের এক হাসপাতালে ভর্তি হন সিরাজের বাবা। সেই মানসিক প্রতিকূলতার কোনও ছাপ সিরাজের পারফরম্যান্সে ছিল না। তিনি পেশাদারিত্বের সঙ্গে পারফর্ম করেছেন মাঠে। আরও একবার সেই পেশাদারিত্বের পরীক্ষা দিতে হলো সিডনিতে বসে। ২০২০ সালের অক্টোবরে তিনি ফের সুযোগ পান অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে। গত ২০ নভেম্বর সিডনিতে অনুশীলনের পর প্রধান কোচ রবি শাস্ত্রী ও অধিনায়ক বিরাট কোহলির কাছে বাবার মৃত্যুর খবর শোনেন সিরাজ। করোনা মহামারীর ফলে কোয়রেন্টাইন নিয়মের কারণে বাবার শেষকৃত্যে যোগ দিতে পারেননি এই ডানহাতি পেসার।
পরে সংবাদ মাধ্যমকে জানান- মনের দিক দিয়ে শক্ত থাকার জন্য তার পাশে ছিলেন প্রধান কোচ এবং অধিনায়ক। তাদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার জন্য মরিয়া ছিলেন সিরাজও। একইসঙ্গে মনের মধ্যে ছিল পরিবারের স্বার্থত্যাগের কথাও।
[৭] ক্রিকেটের নেশার জন্য মা বকাবকি করলেও হাল ছাড়তে নারাজ ছিলেন সিরাজের বাবা মোহাম্মদ গাউস। ছেলের স্বপ্নপূরণের জন্য দিনভর কঠোর পরিশ্রম করতেন। অতিরিক্ত ভাড়া খাটতেন যাতে ছেলের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ বন্ধ না হয়ে যায়।
[৮] টেনিস বলের ক্রিকেটে একাধিক ম্যাচ জেতানোর পরে স্থানীয় কোচিং ক্যাম্পের সেই প্রশিক্ষণে সিরাজকে ভর্তি করে দেন তার বাবা-ই। অর্থাভাবে সেই কোচিং সেন্টারের খরচ চালানোও সম্ভব হত না। কিন্তু ছোটবেলার কোচ কে সাইবাবা খুদে পেসারের প্রতিভা দেখে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়ে যান।
[৯] তাদের সকলের অবদান স্মৃতিতে ঘুরপাক খাচ্ছিল বক্সিং ডে-তে জীবনের প্রথম টেস্টে নামার আগে। মনে পড়েছিল, অনূর্ধ্ব-১৯ প্রতিযোগিতায় নামার আগে জুতো ছিল না সিরাজের কাছে। অটোচালক বাবা সারা রাত ধরে অটো চালিয়ে প্রথম জুতো কিনে দেন। সেই জুতো পায়ে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে বাবার পরিশ্রমকে যথার্থ সম্মান জানান সিরাজ।
[১০] বাবার স্বপ্নপূরণের পথেই জানতে পেরেছেন তার চলে যাওয়ার খবর। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই অজিদের হারিয়ে ভারতের জয়ের অংশীদার হয়েছেন তিনি। কুর্নিশ জানিয়েছেন কাছের মানুষের আত্মত্যাগকে।
[১১] একইসঙ্গে নিজেও অংশীদার হয়ে থাকলেন কুর্নিশযোগ্য পারফরম্যান্সের জন্য। প্রথম ভারতীয় বোলার হিসেবে অভিষেক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ৫ উইকেট নেওয়ার এলিট তালিকায় ঢুকে পড়লেন মোহাম্মদ সিরাজ। শ্রীলঙ্কার পেসার লাসিথ মালিঙ্গা ২০০৪ সালে অভিষেক ম্যাচ খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেই ম্যাচে ২ ইনিংস মিলিয়ে তিনি নেন ৬ উইকেট। সিরাজ নিলেন ৫টি। ছোটবেলায় ভাল জুতো কেনার সামর্থ্য ছিল না। সেই অতীতটা সঙ্গে নিয়েই এখন আরও শক্ত করে বাঁধছেন দামি জুতোর ফিতে। ভবিষ্যতে আরও অনেক দূর যেতে চান হায়দরাবাদের এই তরুণ তুর্কি। সূত্র- জিনিউজ।
আপনার মতামত লিখুন :