নিউজ ডেস্ক: এ দেশের মাটিতে জন্ম নেয়া অনেক বাঙালি বিজ্ঞানী মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পরিবর্তনশীল পৃথিবীকে সুন্দর করে সাঁজাতে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের অবদানও কম নয়। তাদের অবদান সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই সম্যক ধারণা নেই।
পরিচিত এবং অপরিচিত ২১ জন বাঙালি বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে আমাদের সাত পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে তুলে ধরা হবে বিজ্ঞানের অমর প্রতিভা স্পেকট্রোমিটারের আবিষ্কারক ড. আনিসুর রাহমান, সোলার এনার্জি সেলস এর উদ্ভাবক ড. জামালউদ্দিন ও তাপীয় আয়নবাদ তত্ত্বের গবেষক মেঘনাদ সাহার অসামন্য অবদান সম্পর্কে-
স্পেকট্রোমিটারের আবিষ্কারক ড. আনিসুর রহমান
তিনি আবিষ্কার করেছেন একটি বিস্ময়কর প্রযুক্তি। কোনো মানুষের শরীরে বিস্ফোরকের কোনো উপাদান থাকলে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে তা ধরা পড়বে। এ জন্য বর্তমানের এক্স-রে মেশিনের প্রয়োজন হবে না। ড. আনিসুর রহমানের এ প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ এরই মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ আরো বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কিছু নমুনা দিয়েছে ড. আনিসের কাছে। তারা সেগুলো এখন বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। এনবিসি টেলিভিশন ড. আনিসের এই উদ্ভাবন নিয়ে এরই মধ্যে বড় ধরনের খবর প্রচার করেছে।
পেনসিলভানিয়ার বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ড. আনিসের এই আবিষ্কার বিষয়ে রিপোর্ট করতে ব্যাপক আগ্রহী বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ড. আনিসুর রহমান এনবিসি টেলিভিশন নেটওয়ার্ককে জানিয়েছেন, বর্তমান সময়ে সিকিউরিটি এক বিরাট ইস্যু।
স্পেকট্রোমিটারের আবিষ্কারক ড. আনিসুর রাহমান
এটিকে নিশ্চিত করতে গিয়ে সারা বিশ্বে বিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে। মেটালিক কোনো বিস্ফোরক হলে তা যে কোনো জায়গাতেই ধরা পড়ে যায়। তবে এখন বিভিন্ন কেমিকেল পাউডারসহ রাসায়নিক বিস্ফোরকের প্রাদুর্ভাব ও ব্যবহার দিন দিনই বাড়ছে। এ মেশিনে যাতে কোনো ভুল সিগন্যাল এবং সন্ত্রাসীরা সিগন্যালকে লুকাতে না পারে সে জন্য বিশেষ ধরনের প্রযুক্তিগত কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি জানান, এই যন্ত্রের দাম অনেকটাই কম। ভবিষ্যতে হয়তো এর দাম আরো কমবে। এই মেশিন একটি টেবিলে বসানো সম্ভব। এর ফলে যে কেউ কোনো ধরনের রাসায়নিক বিস্ফোরক নিয়ে নিরাপত্তা এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না।
এই মেশিনের সিগন্যাল উপেক্ষা করার কোনো পথ নেই। মেশিনটির নাম হচ্ছে স্পেকট্রোমিটার। এর আরো অনেক প্রয়োগ আছে। এর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে এটি একটি সফল যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। বেশি বা খুবই অল্প বিস্ফোরক হলেও স্পেকট্রোমিটারের চোখ এড়ানো সম্ভব হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ থেকে এ শর্ত ইতোমধ্যে আরোপ করা হয়েছে। ড. আনিসুর রহমানের বাড়ি বাংলাদেশের পাবনায়। দেশে অবস্থানকালে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট আণবিক বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ও ড. শমসের আলীর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে তিনি ছিলেন সাইন্টিফিক অফিসার।
ড. আনিসুর রহমানের বাড়ি বাংলদেশের পাবনায়। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনে অবস্থিত মার্কেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি লাভের পর পেনসিলভানিয়ার অ্যাপ্লাইড রিচার্স ফটোনিক্স কোম্পানির সিইও হিসেবে যোগদান করেন তিনি।
বাংলাদেশী এই কৃতী বিজ্ঞানীকে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসাও বিশ্বের সেরা ৫০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান দিয়েছে। এর স্বীকৃতি হিসেবে নাসা ড. আনিসুর রহমানকে ফেলো হিসেবে মনোনীত করেছে।
সোলার এনার্জি সেলস এর উদ্ভাবক ড. জামালউদ্দিন
বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর সোলার এনার্জি সেলস উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে ম্যারিল্যান্ডের কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং গবেষক বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ড. জামালউদ্দিন ইতিহাস গড়েছেন।
কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটির ন্যাচারাল সাইন্সের সহকারী অধ্যাপক এবং ইউনিভার্সিটির নেনোট্যাকনোলজি রিচার্স সেন্টারের গবেষক ড. জামালউদ্দিন এবং তার পাঁচ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষানবিশ গবেষকরা স্পেক্ট্রোল্যাবের সোলার সেলের তুলনায় প্রায় চার শতাংশের অধিক কার্যকর সোলার এনার্জি সেল উদ্ভাবন করলেন।
এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সোলার এনার্জি সেল তৈরির শীর্ষস্থানটি দখলে রেখেছে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রোল্যাব। ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সোলার সেল তৈরির সুনামটিও তাদের।
নিজের এই উদ্ভাবনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়াতে ড. জামালউদ্দিন জানান, এটা সত্যিই রোমাঞ্চকর এবং আশাব্যঞ্জক একটি বিষয় যা আরো অধিক নেনোটেকনোলজির ওপর গবেষণাকল্পে আমাদের আরো উৎসাহ যোগাবে।
ড. জামাল উদ্দিন এবং তার গ্রুপ সোলার সেল থেকে শতকরা ৪৩ দশমিক চার পুনঃব্যবহারযোগ্য এনার্জি উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করেছে যা বিশ্বে এই উৎপাদনের সর্বোচ্চ মাত্রা। ড. জামাল মেটাফিজিঙ্ক সফট ওয়ার-কমসল এবং পিসি-ওয়ান ডি ব্যবহার করে এই ক্ষেত্রে নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন।
ড. জামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জের মরহুম আব্দুল জলিল ও বেগম ফজিলাতুন্নেছার পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ড. জামাল।
তাপীয় আয়নবাদ তত্ত্বের গবেষক মেঘনাদ সাহা
মেঘনাদ সাহা পরমাণু বিজ্ঞান, আয়ন মণ্ডল, পঞ্জিকা সংস্কার, বন্যা প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণা করেন। তাপীয় আয়নবাদ সংক্রান্ত তত্ত্ব উদ্ভাবন করে জ্যোতির পদার্থবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
মেঘনাদ সাহার জন্ম ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকার কাছে শ্যাওড়াতলী গ্রামে। তিনি তার পিতা জগন্নাথ সাহার আট সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন। একজন সাধারণ মুদি দোকানী পিতার পক্ষে এতবড় সংসার চালানো দুঃষ্কর হয়ে পড়েছিলো। তাই তার পিতা চেয়েছিলেন তিনি এবং তার বড় ভাই দোকানের বিক্রি-বাট্টার কাজে তাকে সাহায্য করবেন।
তবে মেঘনাদের মা এবং চাচা এই পরিকল্পনায় বাধা দিয়ে তার মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করার ব্যবস্থা করেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষায় তিনি খুবই ভালো ফলাফল করেন এবং তার সুযোগ খুলে যায়। ১৯০৫ সালে তিনি ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি হিসেবে পূর্ণবৃত্তি নিয়ে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন।
ঢাকার পর মেঘনাদ সাহার নতুন ঠিকানা হয় কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ। ১৯১১ সালে তিনি সেখানে মিশ্র গণিত বিভাগে ভর্তি হন। নিজের বর্ণগত পরিচয়ের কারণে সেখানে তিনি বেশ অসুবিধায় পড়েন। কিন্তু শত বাধা বিপত্তির মুখেও তিনি নিজের লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়াননি।
নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে যান সাহা। প্রেসিডেন্সি কলেজে মেঘনাদ সাহার সহপাঠী হিসেবে অধ্যয়ন করতেন বাংলার আরেক কিংবদন্তি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর সান্নিধ্য। ১৯১৩ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি এই কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
তাপীয় আয়নবাদ তত্ত্ব
সেখান থেকে জানানো হলো, জার্নাল প্রকাশ করতে হলে এর সামান্য খরচ মেঘনাদ সাহাকেও বহন করতে হবে। কিন্তু মেঘনাদ সাহার নিকট যথেষ্ট অর্থ না থাকায় তিনি জার্নাল প্রকাশ করতে ব্যর্থ হন। দেখতে দেখতে মেঘনাদ সাহার জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের পাট চুকিয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি জার্মান ভাষা শিখেছিলেন।তবে এই শিক্ষা তার জীবনে তখন কোনো কাজে না আসলেও এবার তিনি এর সুফল পেলেন। তিনি এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু দুজনে মিলে ১৯১৯ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের বিখ্যাত আপেক্ষিত তত্ত্বের উপর প্রকাশিত নিবন্ধটির প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেন। এই অনুবাদ ব্যবহার করে ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটন আইনস্টাইনের তত্ত্বের প্রতিপাদন করেছিলেন।
১৯১৯ সাল যেন মেঘনাদ সাহার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসলো। একই বছর তিনি আলোর সনাতন তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি আলোর তত্ত্ব এবং বিভিন্ন মহাকাশীয় ঘটনাবলী ব্যাখ্যায় এর ব্যর্থতা নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। বিশেষ করে ধূমকেতুর লেজের সূর্য বিপরীতে মুখে করে থাকার ঘটনা তাকে প্রবলভাবে ভাবিয়ে তোলে।
তিনি বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব নিয়ে বিশদ গবেষণা করে এর ব্যাখ্যা তৈরি করতে সক্ষম হন। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্ব দরবারে নিজের উপস্থিতি জানান দেন। তার কাজগুলো বিজ্ঞানমহলে ভূয়সী প্রশংসিত হয়। দরিদ্র রাষ্ট্রের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ধ্বংসস্তূপ থেকে হুংকার দিয়ে উঠেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা।
একই বছর তাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব সায়েন্স উপাধি প্রদান করা হয়। হার্ভার্ডের তারকা বর্ণালী সম্পর্কিত শ্রেণীবিন্যাসের তাত্ত্বিক আলোচনার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি প্রদান করা হয়।
শেষলগ্নে মেঘনাদ সাহা পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে তিনি স্বাধীন ভারতের বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে সরাসরি যুক্ত হয়ে যান। ১৯৫৬ সালে তিনি নিউক্লীয় পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নিতে নয়াদিল্লি ভ্রমণ করেন। তবে তখন আর বৈঠকে অংশ নেয়া হলো না তার। কর্মঠ মেঘনাদ সাহা যাত্রাকালে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়েন। এরই সঙ্গে নিভে যায় ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিদ্যার মহাকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশে