ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন: ঘটনাটা পরপর দুই বছর ঘটলো। গত বছরের এই সময়ের মতো এবারও ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলো। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত আসলে বিশ্বের সব দেশেই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। রপ্তানি বন্ধের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ভারতে বন্যায় পেঁয়াজ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবার কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমরা ভারতীয় পেঁয়াজের উপরে অনেকখানি নির্ভরশীল। আকস্মিক রপ্তানি বন্ধে স্বভাবতই আমরা ক্ষুব্ধ। তার উপর, পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘটনাটা এমন সময়ে ঘটলো, যখন আমরা শারদীয় পূজোকে সামনে রেখে আগের চাইতে বেশি পরিমাণে ইলিশ ভারতে পাঠাচ্ছি। যেকোনো ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ট্রল করা আমাদের জাতীয় অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেঁয়াজ নিয়েও এখন ফেসবুকে চলছে ট্রলের সুনামী। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে ভাববার লোক তেমন চোখে পড়ে না। আমাদের বিশেষজ্ঞদের ভূমিকাও আজকাল তেমন চোখে পড়ে না। বিষয়ের গভীরে না গিয়ে ট্রলের সাময়িক খোঁচাখুচিতেই আমাদের আনন্দ অনেক বেশি।
বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানি এবং ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ব্যাপারটাকে দুইভাবে দেখা যায়। সহজভাবে দেখলে এই ঘটনার জন্য ভারতকে দায়ীও করা যায়। তবে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে, কোনো পণ্যের ঘাটতির কারণে কোনো দেশ যদি তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করার জন্য সাময়িকভাবে সেই পণ্যের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে কি সে জন্য তাদের দোষারোপ করা যায়? নিজের পেটে ক্ষুধা রেখে অন্যকে খাবার বিলানোর ঘটনা কি খুব সচরাচর ঘটে? আমরা ভারতকে নিশ্চয়ই বিনামূল্যে ইলিশ পাঠাই না। আমাদের অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি দোকানগুলো মিয়ানমারের ইলিশে ভর্তি। নিরুপায় হয়ে মাঝেমধ্যে কিনলেও স্বাদে-গন্ধে এই ইলিশ পদ্মার ইলিশের ধারেকাছেও নেই।
বাংলাদেশে এখন ইলিশের মওসুম চলছে। ঢাকার বন্ধুরা দল বেধে মাওয়া গিয়ে পদ্মার পাড়ে বসে ইলিশ মাছ খাচ্ছে আর সমানে ফেসবুকে ছবি আপলোড করছে। কেউ কেউ আবার বন্ধুদের জন্যও বিশেষ প্রক্রিয়ায় গাড়ি ভর্তি ইলিশ মাছ আনাচ্ছে। দূর থেকে এসব দৃশ্য দেখে আমি আর আমার ইলিশখেকো সন্তান পার্থিব-পূর্ণতা হাহাকারে মাতি। শহরের একমাত্র বাংলা দোকানে গিয়ে আকস্মিক পদ্মার ইলিশ পেয়ে চড়া দামে কিনি। বাসায় সেই ইলিশ দেখে আমার সন্তানদের খুশি আর ধরে না। প্রাণপ্রিয় নূপুরজান মেতে ওঠেন ইলিশ রন্ধনে।
বাংলাদেশ সরকারের বিগত বছরগুলোয় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে কমপক্ষে পনেরো গুণ। অতীতের চল্লিশ হাজার টনের পরিবর্তে বছরে এখন ছয় লাখ টন ইলিশ মাছ উৎপন্ন হয়। আশা করি ভবিষ্যতে এই উৎপাদন আরও বাড়বে। সুতরাং, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে ইলিশ রপ্তানির মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে বলেই ধারণা করা যায়। ইলিশের সাথে তাই পেঁয়াজকে গুলিয়ে ফেলা কতোটা যুক্তিসঙ্গত, সেটা ভেবে দেখবার বিষয়। গত বছর পেঁয়াজবিষয়ক জটিলতার সময় বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব টিপু মুনশি সিডনিতে ছিলেন। যে কারণে, খুব কাছ থেকে সমস্যাটিকে অনুধাবন করার সুযোগ হয়েছিল। একপর্যায়ে, অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মুনীর হোসেন পেঁয়াজের সন্ধানে নিজ খরচে তুরস্ক পর্যন্ত গিয়েছিলেন। গতবারের ঘটনা থেকে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় শিক্ষাটুকু গ্রহণ করেছে।
সেই প্রাপ্ত শিক্ষার আলোকে মনে হয়, এখন থেকে বাংলাদেশকে প্রতি বছরই এরকম সময়ে পেঁয়াজের সম্ভাব্য ঘাটতির কথা মাথায় রেখেই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে হবে। গত বছরের আলোচনাসমূহ শুনে মনে হয়েছিল, আভ্যন্তরীণ পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশ মনোযোগী হবে। জানি না, এ ব্যাপারে অগ্রগতি কতোদূর। তা ছাড়া, প্রয়োজন হলে পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের বিকল্পও সন্ধান করতে হবে। তুরস্ক, মিশরের মতো দেশগুলো থেকেও পেঁয়াজ আমদানি করা যেতে পারে। সরকারের টিসিবিও পেঁয়াজ আমদানি করতে পারে এবং প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ করতে পারে। টিসিবির ভূমিকা আরো বেশি গণবান্ধব হওয়া জরুরি। শর্তের বেড়াজালে এমনভাবে টিসিবিকে বেধে রাখা হয়েছে যে সব ব্যবসায়ীর পক্ষে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার ফলে, বিশেষ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের অশুভ সিন্ডিকেটগুলো লাভবান হয়। টিসিবির ভূমিকা নিয়ে তাই সরকারকে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। আগে থেকে পরিকল্পনায় থাকলে পেঁয়াজের সাময়িক এসব জটিলতা ভালভাবে সমাধান করা সম্ভব এবং বৃহত্তর জনস্বার্থে এটা করা জরুরিও। কারণ পেঁয়াজের ঝাঁজে শুধু চোখ জ্বলে না, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও জ্বালা ধরে। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :