উন্নত দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে নাগরিকত্ব প্রদানের কথা আমরা মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় দেখি, আবারো দেখলাম গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকের বাংলা সংস্করণের এক লেখায়। সাংবাদিক সাহেব বোল্ড টাইপে সিঙ্গাপুরে এক আমন্ত্রিত নাগরিকত্বের গর্বের কথা বলেছেন, পড়তে ভাল লাগে তো বটেই। কিন্তু এই ভাল লাগার চেয়ে জনগণের জন্যে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যটা সম্ভবত সবচেয়ে জরুরী।
উন্নত দেশগুলোতে কাঙ্ক্ষিত নাগরিকত্ব সংবিধান আর আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অভিবাসনের একটি প্রক্রিয়ার ফসল, এটি আমন্ত্রণের বিষয় নয়, বরং আবেদনের বিষয়। উন্নত, উন্নয়নশীল দেশ কমবেশি সবাই একই নিয়মে চলেন।
সিঙ্গাপুরের সংবিধান অনুসারে নাগরিকত্ব দেওয়া হয় তিন ভাবেঃ by birth, by descent, or by registration. রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেতে হলে স্থায়ী বাসিন্দা (পিআর) হিসেবে ২ বছর সহ অন্যান্য শর্ত (যেমন চাকুরী) পূরণ করা অত্যাবশ্যক। অনারারি নাগরিকত্ব প্রদান ছাড়া রাষ্ট্র নাগরিকত্ব গ্রহনের আমন্ত্রণ জানায় এটি তথ্য হিসেবে একটি সিনেমেটিক ফ্যান্টাসি অর্থাৎ বিভ্রান্তিকর তথ্য। "আরে ভাই ওরে ডেকে নিয়ে নাগরিক বানাইছে", গাল্পিক/স্বাপ্নিক এই বাক্যটির বাস্তবতা কিন্তু একেবারেই ভিন্ন; চায়ের টেবিল আলোচনায় চলে, কলামে নয়। মেধাবীদের নিজেদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া বহু উন্নত দেশেই আছে। এই বিষয়টি সিনেমেটিক নয় বরং একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হয়, নিজ থেকে আবেদন করতে হয়, অভিবাসনের শর্তগুলো পূরণ হলে অনুমোদিত হয়।
জাপানে এলিট ফরেনার্স এক্ট আছে, যেখানে জাপানি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রীধারী আয় রোজগার করা বিদেশীরা ১০ বছরের জায়গায় ৫ বছরেই স্থায়ী রেসিডেন্সী (পিআর) পাবে যদি নিজেকে জাপানের অর্থনীতির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করতে পারেন। জাপানে বিদেশীদের নাগরিকত্ব এখন ডুমুরের ফুল নয়, আইন অনুসরণ করে শর্ত পূরণ সক্ষমতায় সাধারণ বাস্তবতা, অনেক বাংলাদেশীই জাপানি নাগরিক। না ভাই, সরকার আমন্ত্রণ করে না, করার ক্ষমতাও নেই। দায় আপনার, তাই আপনাকেই আবেদন করতে হবে।
কানাডায় স্কিলড ইমিগ্রেশন (শিক্ষা, ভাষা, চাকুরীর অভিজ্ঞতার পয়েন্ট ভিত্তিক) ব্যবস্থাটি তো বহু বছর ধরেই আছে। অস্ট্রেলিয়া আর ব্রিটিশরাও তাঁদের পন্থায় মেধাবীদের প্রাধান্য দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা, ভাষা, শিক্ষা, চাকুরী ইত্যাদির ভিত্তিতে বিশেষ ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া আছে যাতে মেধাবী বিদেশীরা গ্রীন কার্ড পেয়ে থাকেন। ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ওয়েভার; এক্সট্রা অর্ডিনারি অ্যাবিলিটি ১, ২ প্রোগ্রাম এর মাধ্যম গ্রীন কার্ড পেয়ে ৫ বছর পর অন্যান্য শর্ত মেনে সাধারণত নাগরিকত্বের যোগ্যতা অর্জিত হয়।
বিজ্ঞান গবেষণায় বিশ্বের সেরা দুটো জার্নাল হচ্ছে সায়েন্স আর ন্যাচার। গবেষকদের স্বপ্নের এই জার্নালদ্বয়ে পাবলিকেশন মানে অন্যরকম উচ্চতা। এই উচ্চতায় পৌঁছে ভাল পজিশনের অফার হয়তো পাবেন, পিআর বা গ্রীন কার্ডের আবেদনের যোগ্যতা হয়তো হবে, তাই বলে কোন দেশের নাগরিকত্বের রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ??? কোন উন্নত দেশের সরকার আমন্ত্রণ জানিয়ে কাউকে নাগরিকত্ব গ্রহনের প্রস্তাব দেন এই তথ্য বিভ্রান্তিকর, বিভিন্ন উন্নত দেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিকও বটে। কলাম বা ফিচার লেখকদের কি লিখছেন এই বিষয়ে সচেতনতা খুব জরুরী।
আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯২১ সালে নোবেল পান, ১৯৩৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, নাগরিক হন ১৯৪০ সালে, প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, নাগরিকত্বের তথাকথিত রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ ভাগ্যে জুটেনি। আরেক নোবেল জয়ী আমাদের কবিগুরুকে একদা বিব্রত হতে হয়েছিল ইউএস ইমিগ্রেশনে।
উন্নত দেশে ইমিগ্রেশনের নানা কাহিনী, বিব্রতকর অনেক ঘটনা। রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ করার নজীর নেই, চলে সংবিধান আর আইন বলে। ইমিগ্রেশনের অনেক কর্মী এই সুযোগে নিজেদের বিধাতার কাতারে নিয়ে যান ফলে ভুক্তভোগীর সংখ্যাও অনেক।
রিপোর্ট করতে গিয়ে সংবাদপত্রটি আর সাংবাদিকের নিজের ফেসভ্যালুর প্রতি অবিচার করা বোধ হয় উচিত নয়। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা অনেক সময় মোহাবিষ্টতায় এতটা আবদ্ধ থাকে, প্রথম রিপোর্টের সৃষ্ট বৃত্ত থেকে আর বের হতে পারেন না। নতুন নতুন তথ্য উপাত্ত, যুক্তি, বাস্তবতা কোন কিছু দিয়েই এই বৃত্ত ভেদ করা যায় না। একসময় ডাইনামিজমের মাধ্যমে আপটুডেট চিন্তা ভাবনায় মানিয়ে নেবার চেয়ে ইগোটাকে প্রতিষ্ঠিত করার জেদ চেপে যায়। রাজনীতি থেকে সাংবাদিকতা, চারিদিকে একই চিত্র।
কোভিড উপদ্রুত বিশ্ব বড় সংকটে ৬-৭ মাস পেরিয়ে এসেছে, রোগ নির্ণয়ে এন্টিবডি টেস্টে এখন পর্যন্ত কোথাও প্রতিষ্ঠিত নয়, অথচ আমাদের বাংলাদেশে এ নিয়ে লঙ্কা কাণ্ড, মাঝখানে জনগণ বিভ্রান্ত। জনগণকে হাইকোর্ট দেখাতেই আমাদের বুদ্ধিজীবিতা, বস্তুনিষ্ঠতা নয়। ফেসবুক থেকে।
আপনার মতামত লিখুন :