দীপক চৌধুরী : ঘুরেফিরে এখন অনেকেই মায়াকান্না করে, নির্বাচন পদ্ধতির কথা, গণতন্ত্রের কথা শেখান, অধিকার বোঝান, পরিবেশের কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেন। অথচ গণতন্ত্রের লেশমাত্র ছিল না তাদের আমলে, তাদের শাসনামলে কী এসবের একটাও ছিল? জিয়াউর রহমান বা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের কথা বলুন। গণতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য কী কী করা দরকার ছিল- সেটি বের করা একমাত্র কাজ ছিল। বঙ্গবন্ধু সবকিছু উৎসর্গ করেছিলেন মানুষের জন্য, দেশের জন্য। বাংলার মানুষের ধমনিতে রয়েছে তাঁর অস্তিত্ব। আজ শোকের মাসের শেষ দিন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শিকার হন বর্বরোচিত ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের। রাতের শেষপ্রহরে সংঘটিত হয় এই মহাদুর্যোগ। গণতন্ত্রের আজীবন সাধক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা হত্যার পর ‘গণতন্ত্র হত্যার’ আর কী কোনো উদাহরণ থাকে?
ওই পার্ট শেষ তাদের কাছে। তাদের মাথায় এখন কেবল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঘোরাঘুরি করছে। এ সংগঠনকে ভয় বেশি। শুধু চিন্তা কীভাবে এ সংগঠনকে জব্দ করা যায়! আওয়ামী লীগের ডানা কেটে ফেলার চেষ্টা কম হয়নি। জিয়া যেমন চেষ্টা চালিয়েছিলেন ব্যর্থ হন, ঠিক তেমনি এরশাদও। একপর্যায়ে এরশাদ মনের দুঃখে তার ছাত্র সংগঠন ছাত্র সমাজ নির্মূল করে ফেললেন। নিষিদ্ধ করে ফেললেন এর কর্মকাণ্ড। রফিক হাফিজের কী কান্না! শেখ হাসিনার প্রাণ এ সংগঠনে। তিনি কখনো ক্ষুব্ধ হন কতিপয় নেতার আচরণে, আবার কাছে টেনে নেন। আমাদের ইতিহাসের গৌরবজনক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সর্বাগ্রে আনতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রধান ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর সেই গণতন্ত্রের অবস্থা এখন মজবুত হয়েছে। এটা স্বীকার করতেই হবে। এটি সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান লক্ষ্যগুলোর একটি ছিল গণতন্ত্র। জনজীবনে সম্ভাবনা আছে। জনসাধারণ এখন অনেক সচেতন।
বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগকে মনে করতেন তার বুকের পাঁজর-কলিজা। অসুস্থ শরীর নিয়ে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে গিয়েছিলেন ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে। সে বছর ১৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণে এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘যতদিন এদেশে দুঃখী মানুষ পেট ভরে খেতে না পারে, যতদিন অত্যাচার ও অবিচারের হাত থেকে তারা না বাঁচবে, যতদিন- না শোষণমুক্ত সমাজ হবে, ততদিন সত্যিকারের স্বাধীনতা আসতে পারে না। রাজনৈতিক স্বাধীনতা আনতে যে ত্যাগের প্রয়োজন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আনতে তারচেয়ে বেশি কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন। রাতারাতি হয় না। কোনোদিন হয়নি। বস্তুত এর কোনো সোজা পথ নেই। ধীর পদক্ষেপে এগোতে হবে। এজন্য অনেক ত্যাগ প্রয়োজন। অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন। একদিনে হয় না। আমার রাজনৈতিক জীবনে আমি এ সত্য বহুবার উপরব্ধি করেছি।’’.. .. .. বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পরপরই মুক্তিযুদ্ধোত্তর নানান সংকটের কঠিন দিনগুলোতে বাঙালি জাতীয়তাবোধের গভীরতা থেকেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এদেশের সকল শ্রেণির মানুষের প্রিয় ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগিতা ও অপকর্ম করার জন্য ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর চারটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল সরকার। ১. মুসলিম লীগ, ২. নেজামে ইসলাম, ৩. জামায়াতে ইসলামী ও ৪. পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)। অথচ ’৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই থেমে যায়নি ঘাতকচক্র। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী-রাজাকারদের দলে টেনে এনে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, যারা পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিল তাদের প্রতিষ্ঠিত করা হলো কীভাবে? শুধু তাদের ‘তা-না-না-না’ ছাড়া এর জবাব কিন্তু এখনো পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার জন্য যেখানে ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছে, দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জিত দিতে হয়েছে- সেই শত্রুরা কীভাবে দেশে রাজনীতি করে? যাদের প্রধান কাজ ছিল বাঙালি নারী-শিশুদের ধর্ষণ হত্যা করা। মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া নানা তথ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অকথ্য, ভয়ঙ্কর ও নৃশংস নির্যাতনের চিত্র মিলে। যেমন -‘‘আমাদের সংস্থায় আসা ধর্ষিত নারীদের প্রায় সবারই ছিল ক্ষত-বিক্ষত যৌনাঙ্গ। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিঁড়ে ফেলা রক্তাক্ত যোনিপথ, দাঁত দিয়ে ছিড়ে ফেলা স্তন, বেয়োনেট দিয়ে কেটে ফেলা স্তন-উরু এবং পশ্চাৎদেশে ছুরির আঘাত নিয়ে নারীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসতো।" -মালেকা খান, যুদ্ধের পর পুনর্বাসন সংস্থায় ধর্ষিতাদের নিবন্ধীকরণে যুক্ত সমাজকর্মী।
‘‘১৮ ডিসেম্বর মিরপুরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া একজনকে খুঁজতে গিয়ে দেখি মাটির নিচে বাঙ্কার থেকে ২৩ জন সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মাথা কামানো নারীকে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে পাক আর্মিরা।’’ -বিচারপতি এম এ সোবহান।
মেয়েদের তারা পণ্যের বাইরে কখনো চিন্তা করেনি। এখন ২০২০ খ্রিস্টাব্দ। রাষ্ট্রের বড়বড় পদে নারী, গুরুত্বপূর্ণ পদেও। মাঠেও নারী। ডিসি, এডিসি, ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেট, ওসি সর্বত্র। দেখি এখন সেই নারীর ক্ষমতায়ন। সেসব বেহায়াদের মুখ এখন তো চুপসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওরা এখন উল্টোটা বলে। অতীতকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। ট্রাফিকে নারী পুলিশ নেওয়া যাবে না। সার্জেন্ট হিসেবে নাকি নারী নেওয়া ঠিক হবে না। কে বলেছেন, মতিউর রহমান নিজামী। কারণ, নিজামী তখন কৃষিমন্ত্রী। অথচ এই নিজামীকে যুদ্ধাপরাধে ও মানবতার অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু মানুষের হৃদয়ে আছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন বিদেশে ছিলেন বলেই প্রাণে রক্ষা পান। বঙ্গবন্ধু মানুষের ভালবাসার দুর্লভ সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। কিন্তু সেই নেতাকে ঘাতকরা বাঁচতে দিলো না।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিলে তিলে গড়ে উঠেছে সেই আওয়ামী লীগ। এর পেছনে বঙ্গবন্ধুকন্যা। আজ দেশের এক নম্বর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সেই দলেরর নেতাদের কেউই চিরকাল থাকবে না। সুতরাং নতুনদের গড়ে তুলতে হবে। সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে ঢাকা-১৮, হাবিবুর রহমান মোল্লার মৃত্যুতে ঢাকা-৫, মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে সিরাজগঞ্জ-১, শামসুর রহমান শরিফ ডিলুর মৃত্যুতে পাবনা-৪ ও ইসরাফিল আলমের মৃত্যুতে নওগাঁ-৬ আসন শূন্য রয়েছে। পাঁচটি সংসদীয় শূন্য আসনেই মারা যাওয়া সংসদ সদস্যের পরিবারের স্বজনরাও প্রতিযোগিতা করছেন। এখানে খারাপ কিছু নয়। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কথা হলো বা মন খারাপের কথা হলো তারা শুধু প্রবীণ নয়, তারা বঙ্গবন্ধুকন্যার পরীক্ষিত নেতা ছিলেন। সুতরাং তরুণদের দিয়ে দলে তারুণ্য আনা জরুরি। ছাত্রলীগ করা ছেলে কখনো অন্যদলে দল পাল্টে যাবে না। নতুন দলে যাবে না আর গেলেও সুবিধা করতে পারবে না। মেধাবী বহু তরুণ আছেন যারা পদে নেই। কিন্তু দলের সাংগঠনিক কাজে তাদের দেখা মিলে। তারা এগিয়ে যান। এ শক্তিকে অস্বীকার করা ঠিক হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী কঠিন হন না? দায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না? অবশ্যই নিয়ে থাকেন। কোনো কোনোটা চোখে পড়ে, কোনোটা না। বছর খানেক আগের কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ১৯৭৫-এর ১৫ আগষ্ট শহীদ হওয়া শেখ ফজলুল হক মণির ভাই শেখ মারুফকে এক বছর আগে নিষ্ক্রিয় করা হয়। তিনি ব্যবস্থা নেননি! শেখ হাসিনার আত্মীয় সাবেক আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরকে কী এতোটুকু ছাড় দেওয়া হয়েছে? স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট কাওসার মোল্লা, একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ এমপি, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এমপিরা এখন দলে নিষ্ক্রিয়। সংগঠনে বা দলে ঠাঁই নেই। আওয়ামী লীগ ও দলের অঙ্গসংগঠনের জন্য তাদের প্রত্যেকের ত্যাগ আছে। সাংগঠনিক ক্ষমতা আছে, দক্ষতা আছে। নুরুন্নবী শাওনের বিভিন্ন ঘটনা এখনো দুর্নীতি কমিশন তদন্ত করছে। সুতরাং এটাই সত্য যে, কোনো অপকর্ম-অন্যায়ের কারণে কাউকে ছাড় দেন না শেখ হাসিনা। প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ত্যাগী নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একটি কথা প্রায়ই রসিয়ে রসিয়ে তার ধারায় বলতেন, ‘বাঘে ধরলে ছাড়ে কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়াছাড়ি নাই।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকন্যার সিদ্ধান্ত ও সবল প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গীকে উচ্চমাত্রাস্থলে বোঝাতে বারবার এমপি হওয়া সুরঞ্জিত একথা বলতেন। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যাত্রার কিছু পরই মারাত্মক ধাক্কা খেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র সাড়ে তিন বছরে আমাদের জন্য সবকিছু গড়ে দিয়ে গেছেন বলে গতকাল মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি প্রথম ক্ষমতায় এসে দেখলাম, রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য সব কিছুর ভিত তৈরি করে গেছেন বঙ্গবন্ধু। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ মানুষের মৌলিক চাহিদা কীভাবে পূরণ হবে, দেশের আইন কী হবে, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, গরিবের সহায়তা করাসহ সব বিষয়ে তিনি কাজ করে গেছেন।’ সরকারপ্রধান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এতকিছু করার পর কিছু কিছু লোক লেখে, কোনও উন্নয়নই নাকি হয়নি। কেন? কী উদ্দেশে তারা এগুলো বলে। অনেকে গণতন্ত্রের কথা বলে। মার্শাল ল দিয়ে কখনও গণতন্ত্র হয় না।’
আসলে, আমি বলি কী ; কিছু লোক আছেই যারা জেগে ঘুমোয়। জেগে ঘুমোলে জাগানো যায় না। আমাদের হয়েছে সেই অবস্থা। চোখ বন্ধ করে বলা যায়, অস্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি করার চেষ্টা বিএনপি-জামায়াতের রয়েছে। একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ন্যায়সংগত ও আইনসংগত কথাও বলতে সাহস করে না। তারা শেখ হাসিনার সরকারকে ভয় পান যে তা কিন্তু নয়। তারা ব্যক্তি স্বার্থের প্রয়োজনে দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহৃত হতে ভালবাসেন।
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, কথাসাহিত্যিক