এম নজরুল ইসলাম : রাজনীতির ইতিহাসে কিছু কিছু ঘটনা কি ঘুরে ঘুরে আসে। যদি বলা হয় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। আমাদের দেশের রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধুকে কোনো দিন মুছে ফেলা যাবে না। যদিও তাঁকে হেয়প্রতিপন্ন করার অনেক চেষ্টাই হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক বন্ধুর পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতিতে অভিষেক যেমন তাঁর জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না, তেমনি মসৃণ নয় তাঁর রাজনৈতিক চলার পথটিও। পায়ে পায়ে পাথর ঠেলে শেখ হাসিনাকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। কিন্তু জনগণকে আস্থায় নিয়ে রাজনৈতিক কল্যাণের যে পথযাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁর, তা থেকে তাঁকে বিচ্যুত করা যায়নি। ১৯৮১ থেকে দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রাটি একেবারেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। কণ্টকাকীর্ণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। বাবার মতোই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন। নিঃসঙ্গ পরবাসে স্বামী-সন্তান নিয়ে গভীর বেদনার দিন পার করতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পরিবারের অন্য সদস্যদের হারিয়েও স্বদেশে ফিরতে পারেননি তিনি। দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পরও ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করেছে ঘাতক। একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
একসময় রাজনীতি থেকেই তাঁকে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টা করা হয়। সাল ২০০৭। সে এক দুঃসহ দিন। বাংলাদেশে তখন চলছে চেপে বসা অপশক্তির দুঃশাসন। ওই বছর ১৬ জুলাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশকে সত্যিকারার্থেই দুর্যোগের মেঘে আচ্ছন্ন করেছিল। গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠিয়ে চেপে বসা শাসকগোষ্ঠী তখন রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননে ব্যস্ত। রাজনীতি তখন যেন গর্হিত অপরাধ। রাজনীতিক পরিচয়টিও যেন হানিকর। শাসনের নামে ত্রাসের রাজত্ব। সেই দুর্বিষহ দিনে, ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
টেলিভিশনের পর্দায় সেই গ্রেপ্তারনাটক চাক্ষুষ করেছে বাংলাদেশের মানুষ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরাপত্তারক্ষীদের অপ্রয়োজনীয় অথচ অতিনাটকীয়তায় শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের সেই বার্তা দেশ থেকে বিদেশে প্রচার হতেও সময় লাগেনি। ঢাকায় রাত পৌনে ৪টায় যৌথবাহিনী ঘিরে ফেলল সুধা সদন—জননেত্রী শেখ হাসিনার তখনকার বাসভবন। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় তখন মাঝরাত। সেলফোনে ভেসে এলো আওয়ামী লীগের তৎকালীন পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক, বর্তমান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কণ্ঠস্বর। বললেন, এইমাত্র আপাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে—মাত্র একটি বাক্যেই কথা শেষ। সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রিয়ায় বসবাসরত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ও অনুসারীদের ফোন করে ঘুম থেকে জাগিয়ে নেত্রীর গ্রেপ্তারের খবর দিয়ে সকাল ৮টায় অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় স্টার্ড পার্কে শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ ও মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ আহ্বান করি। ফোন করি লন্ডনে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাকে। ফোনের ওপারে তাঁর কণ্ঠেও হতাশা। আমি আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাই তাঁকে। তিনি আমাদের উৎসাহ দেন। তাত্ক্ষণিকভাবে ‘শেখ হাসিনা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের পরামর্শ দেন। অস্ট্রিয়া সময় সকাল ৮টায় বিপুলসংখ্যক বাঙালি নারী-পুরুষ উপস্থিত হন বিক্ষোভ সমাবেশে। অস্ট্রিয়াপ্রবাসী সর্বস্তরের বাঙালিকে নিয়ে ‘শেখ হাসিনা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়।
তবে সবাইকে ছাপিয়ে যায় শেখ পরিবারের সদস্যদের প্রয়াস। প্রিয়জনের মুক্তির চেষ্টায় সম্ভাব্য সব পথে হেঁটেছেন এই পরিবারের প্রত্যেক সদস্য। শেখ হাসিনার সৌভাগ্য, তিনি এমন এক পরিবারের সন্তান, যে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অটুট পারিবারিক বন্ধন, পারস্পরিক নৈকট্য থেকে কাউকে বিচ্যুত হতে দেয় না। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সদস্যরা হয়তো কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু ইতিকর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি কেউই। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলে মুক্ত করতে তাঁর যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ছোট বোন শেখ রেহানা এবং যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় টেলিফোনে সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বিভিন্ন নির্দেশনা ও উপদেশ দিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন প্রত্যয়দৃপ্ত। শেখ রেহানার দুই কন্যা টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রুপন্তি, ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি সব সময় শেখ হাসিনার মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তাঁর মুক্তির ব্যাপারে আইনি লড়াই করতে সুদূর কানাডা থেকে আন্তর্জাতিক আইনজীবী অধ্যাপক ড. পায়াম আকাভান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী উইলিয়াম স্লোন ওই সময় বাংলাদেশে আসেন।
আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রের যে বিষয়টি সবার আগে দৃষ্টি কাড়ে তা হচ্ছে তাঁর গভীর প্রত্যয়। দেশ ও মানুষের কল্যাণে তিনি সব সময় নিবেদিত। গভীর সংকটেও তিনি জনগণের কল্যাণ চিন্তা করেন। তাঁর সেই চিন্তার প্রতিফলন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সব অর্জনে।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেপ্তারের পর নিঃসঙ্গ কারাবাসে শুধু শুয়ে-বসেই দিন কাটেনি তাঁর। সৃজনশীল জননেত্রী সেই নিঃসঙ্গ-একাকিত্বের দিনগুলোতে দেশ ও জনগণের কল্যাণে ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমার পরিকল্পনা করেছেন। সেই স্মৃতিচারণা করে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা হয়েছিল, একেবারে একা। আমি জানি আমার বিরুদ্ধে অনেক মামলা, আমি যাতে নির্বাচন করতে না পারি, আরো অনেক রকম পরিকল্পনা ছিল বা আমি যেন আর রাজনীতিতে থাকতে না পারি সেই ধরনের অনেক ষড়যন্ত্র। ...সেই সময় বসে বসে আমি লিখে রেখেছিলাম, ২০০৮-এর মধ্যে নির্বাচন হলে যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায়, তাহলে দেশের জন্য কী করব? ...২০১১ সালে আমরা কী করব, ২০১২ সালের মধ্যে কী করব, ২০১৩ সালের মধ্যে কী করব, ২০১৪ সালের মধ্যে কী করব ও ২০১৫ সালের মধ্যে কী করব—এভাবে আমি প্রত্যেকটা বিষয় লিখে রেখেছিলাম।’
জরুরি অবস্থার অবসানের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। রাজনীতির জটিল পথে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকার নিয়ে চলছেন তিনি। নিঃসঙ্গ কারাগারে বসে দিনের পর দিন যে উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন, দেশ ও জাতির অগ্রগতির যে চিন্তা করেছেন, তারই প্রতিফলন আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিটি স্তরে। সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১১ বছরের আর্থ-সামাজিক ও মানব উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হচ্ছে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এই উন্নয়নের পথে অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। কল্যাণমন্ত্রে দীক্ষা যাঁর, জনকল্যাণকে ব্রত করেই তিনি পথ চলছেন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে।
বাংলাদেশের জনগণের জয় হোক। ১৬ জুলাই নতুন মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার দিন।
লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি
nazrul@gmx.at
সূত্র : কালের কণ্ঠ