আসিফুজ্জামান পৃথিল : বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া এক জটিলতর কূটনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। সম্ভবত ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশদের চলে যাবার পর এই অঞ্চলে আগে কখনই এতোটা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়নি। এর পেছনে ভারতের দায়ই আসলে সর্বাধিক।
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেছে।তবে কূটনৈতিকভাবে সেটাকে কতটা সুসম্পর্ক বলা যায় তা প্রশ্নের দাবি রাখে। আগে যদি নেপাল আর ভুটানের কথা ধরি, এই দেশদুটো ল্যান্ডলকড। দু দেশেরই চীনের সঙ্গে সীমান্ত আছে। কিন্তু সেদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয় ও পামির মালভূমি। স্বাভাবিক বাণিজ্য এতোদিন ছিলো অসম্ভব বিষয়। কিন্তু চীন তিব্বতের প্রভূত উন্নয়ন করেছে। হাইওয়ে, রেলপথ এমনকি দ্রুতগতির রেলপথ, কি হচ্ছে না চীনে! ফলে এই দেশদুটোর জন্য বিকল্প তৈরি হয়েছে। ভারতের সু্বিধার জন্যই এই দুই দেশে রাজতন্ত্র ব্যাপক জরুরী ছিলো। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।
নেপালের মাওবাদীদের বহু চেষ্টা করে দমন তো করাই যায়নি, বরং তারা এখন নেপালের ক্ষমতায় বসে আছে। পুস্প কমল দাহাল প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। কিন্তু তাতে কিউ বা এসে যায়। ওলি হতে পারে নেপালের ফেস। কিন্তু মস্তিস্ক অবশ্যই প্রচণ্ড। আর ভুটানের বিষয়টি একটু অন্যরকম। কোনও আন্দোলন নয়, ভুটানের অক্সফোর্ড পড়ুয়া রাজা স্বেচ্ছায় গণতন্ত্র দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যে পড়ার সময় তিনি কিছুটা গ্রিন পার্টি ঘেঁষা ছিলেন। ভুটানের নীতি নির্ধারণে তার স্পষ্ট্ প্রভাব পড়ছে এখন। ভুটানিরা এখন ‘স্বাধীনতা’ চায়।
এর কিছুটা প্রভাব তাদের কার্যক্রমে স্পষ্ট। পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিমান উড্ডয়নের উপযোগী নয়। ভারত বেশ কয়েকবার তাদের প্রস্তাব দিয়েছিলো বাগডোগরা ব্যবহারের জন্য। কিন্তু ভুটান তাতে আগ্রহী ছিলো না। এমনকি উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে একটি নতুন বিমানবন্দরের প্রস্তাবও তারা গ্রহণ করেনি। ভোটদের প্রধান আগ্রহ সৈয়দপুর বিমানবন্দর। বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনাও হয়েছে। বাঁধা ভারতের ট্রানজিট। ভুটান বারবার চেয়েছে ট্রানজিট ভিসা ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ (নেপালও তা চায়)। তবে ভারত ট্রানশিপমেন্ট নামে মুলাই ঝুলিয়ে গেছে এতোদিন। বিষয়টা ভুটান অন্তত ভালোভাবে নেয়নি।
এই দুই দেশ জ্বালানী তেলের উপর জন্য ভারতের উপরই শতভাগ নির্ভর করে। এরআগে তেল সরবরাহ বন্ধ করে নেপালকে ব্ল্যাকমেইল করেছে ভারত। ভুটান তাই তেলের পথ থেকেই সরে এসেছে। নেপাল বিশ্বের একমাত্র দেশ হবার পথে রয়েছে যারা এক বিন্দু তেল ব্যবহার করবে না।সেমস্যার শুরুটা আসলে ওখান থেকেই।
নেপাল লিপুলেখ পাসকে নিজের দাবি করছে এর পেছনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কারণ। লিপুলেখ তিব্বত, নেপাল আর ভারতের জংশন্ ১৯৫৪ সালে ৩ দেশ একমত হয়, ভিসা ছাড়াই এই পাস ব্যবহার করে ভারতের তীর্থযাত্রীরা কৈলাশ যেতে পারবেন। এই সহজগম্যতা ভারতীয়দের বিস্মৃত করেছিলো কৈলাশ আদতে ভারতের কিছু নয়। মানস সরোবরও ভারতের নয়। এটি মানবিক কারণে তারা ব্যবহার করতে পারে। ভারতের শীর্ষ হিন্দু নেতাদের একাংশের ধারণা ছিলো কৈলাশ শিবের আবাস হওয়ায় তা হিন্দুদের প্রাপ্য। হায় আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ধর্মের গুরুত্ব আছে, কিন্তু তা নিয়ামক নয়। নেপাল যে ৩টি স্থানর লিপুলেখ, লিম্পুয়াধারা আর কালাপানি নিজেদের বলে দাবী করছে, তা আসলে ভারত-নেপাল-চীন ট্রাই জংশন। এখানে ভারত বলপ্রয়োগ করতে পারবে না। কারণ চীনও এতে আ্রকান্ত হবার দাবী করতে পারবে। নেপালের কূটনীতিকরা যে চাল চেলেছেন তা হাততালি পাবার যোগ্য অ্যাকাডেমিকালি।
ভুটানও এর সুযোগ নিতে পিছপা হয়নি। আসামে সেচের জন্য পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতের কূটনীতিকরা বলছেন, নদী, হিমবাহ আর পানি প্রকৃতির সম্পদ। কোনও নির্দিষ্ট দেশ এর অধিকার দাবী করতে পারে না। ভুটানের কূটনীতিকরা এই বক্তব্যে নিশ্চয়ই এক চোট হেসেছেন। কারণ পানি নিয়ে রাজনীতি ভারতের চেয়ে বেশি কেউ করেনি এই অঞ্চলে।
ভারতের সবচেয়ে পরীক্ষিত বন্ধুর নাম বাংলাদেশ। এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ ভারতের জন্য যা করেছে, দিল্লি যদি প্রতিদিন ২ বার করে ঢাকাকে ধন্যবাদ দেয়, কম হয়ে যাবে। কিন্তু দিল্লির আচরণ সবসময়েই ছিলো অবহেলা করার মতো। বিজয় আর স্বাধীনতা দিবসে বাংলায় স্ট্যাটাস দিলেই বন্ধুর হক আদায় হয় না। এক তিস্তা নিয়েই যে জল ঘোলা হয়েছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষাক্ত করতে তাই তো যথেষ্ঠ। মমতার ঘাড়ে বন্দুক রেখে বেশিদিন পার পাওয়া যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দাবিটা তো অযৌক্তিক ছিলো না। শুধু গজলডোবায় পানি প্রত্যাহার হয়না তিস্তার। পানির বাটোয়ারা সিকিমে হওয়াই যৌক্তিক ছিলো। সাউথ ব্লক এই সমস্যাটা সবসময়ই জিইয়ে রাখতে চেয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বাংলাদেশের জন্য ছিলো অবমাননাকর। যে২ই দেশের জন্য আপনি সেনাবাহিনীর একটা অংশকে ফ্রি রেখে নর্দান আর ওয়েস্টার্ন সেক্টরে মোতায়েন রাখতে পেরেছেন, তাদেরকে অবমাননা অবশ্যই কূটনৈতিক আত্মহত্যা।
ভারত বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। চীন অবশ্যই এর সুযোগ নেবে। কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোকে এবার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পা ফেলতে হবে। এটাই সুযোগ সত্যকারের কার্যকরী সার্ক গঠনে ভারতকে চাপ দেবার। বিমসটেকের মুলা আর নয়। সার্কেই অনেক সমাধান লুকিয়ে আছে। এর আগে সার্কের গঠনতণ্ত্র বদলাতেই হবে। সার্ক অবশ্যই এমন প্ল্যাটফর্ম হতে পারে, যেখানে দ্বিপাক্ষিক সমস্যার আলোচনা করা যাবে। এছাড়া সার্কের কোনও মূল্য নেই। বাংলাদেশ বড় অর্থনীতির কারণে চীনের পেটে ঢুকবে না। কিন্তু চীন যেভাবে উপহারের বস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর যাই হোক বাংলাদেশে চীনের প্রতি সিম্প্যাথি জোরদার হবেই। প্রপাগান্ডা কূটনীতিতে কিন্তু বিপর্যয়ও ডেকে আনে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, জনপথ রোড আর সাউথ ব্লক তা জানে।
ফেসবুক থেকে