দীপক চৌধুরী : করোনাভাইরাস নিয়ে গোটা দুনিয়ায় আতঙ্ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ সংকটে বিশ্ব, একথা বলেছে জাতিসংঘ। আপাতত এর একমাত্র পথ কোয়ারেন্টিন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও সঙ্গে হাতধোয়া। সারা দুনিয়ায় এই বিষয়টির একমাত্র স্লোগান তা। ঢিলেঢালা ব্যবস্থাপনার কারণে ইতালি ও স্পেনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বিশ্বের মোড়লদেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা জানি। কোথাও কিছু করার নেই ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও। আতঙ্ক আর কান্নার নগর নিউইয়র্ক। অলিম্পিক একবছরের জন্য পিছিয়েছে। জলবায়ু সম্মেলন হচ্ছে না। গত বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসটির কাছে মানুষ কত অসহায়! আর বাংলাদেশের অবস্থা? সবধরনের সহযোগিতা ও প্রশাসনের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারের পরও একশ্রেণির মানুষের মশকরা সত্যিই উদ্বেগের। ত্রাণবিতরণের নামে ফটোসেশন চলছে যেন। সামজিক দূরত্ব কীভাবে ধ্বংস করা যায় এর প্রতিযোগিতা দেখছেন বাংলাদেশের মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপের মতো আমরা করোনামুক্ত থাকতে পারছি না কেন? কেবল তো একশ্রেণির মানুষের অসহযোগিতায়? বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জমায়েত বা সমাবেশ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। গরিব মানুষদেরও পেট আছে একথা বিবেচনায় ত্রাণ দেওয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন কাজ করছে। মানুষ মানুষের পাশে খাদ্য ইত্যাদি নিয়ে এগিয়ে আসছে। সরকার প্রতি ইউনিয়নে ৪০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দিচ্ছে/ দিয়েছে। তৃণমূলে ত্রাণ পাওয়ার যোগ্যদের তালিকা করে দেওয়া হচ্ছে খুঁজে খুঁজে। এ ব্যাপারে অবশ্য সমালোচনাও আছে যে, যারা ত্রাণ পাওয়ার হকদার তারা পাচ্ছেন কী। অবশ্য এ বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, আমাদের হাতে এখন প্রচুর কিট আছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজনীয় ও বাস্তবভিত্তিক সকল পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি ভিডিও কনফারেন্স করেছেন জেলায় জেলায়; যেটি জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স সারাদেশের খোঁজ নিয়েছেন শেখ হাসিনা। এই ভিডিওকনফারেন্সে সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি ছিলেন। নাগরিকদের কর্তব্য ঘরে থাকা। আমাদের ঘরে থাকতেই হবে। সঠিক কিংবা যথাসময়ে লকডাউনে গেছে। উহান থেকে বাংলাদেশিদের নিরাপদে ফেরত এনেছে। স্কুল-কলেজ তাড়াতাড়ি বন্ধ করেছে। কোয়ারেন্টিনে রাখার জন্য প্রবাসফেরতদের বিষয়ে প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু অপ্রিয় সত্য যে, গত কিছুদিনের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে কঠোর হতেই হবে প্রশাসনকে।
করোভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে মানুষের অবাধ চলাচলে কড়াকড়ি আরোপে পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। আরো জানা গেছে, বিদেশ থেকে ঢাকায় ফিরে আসা লোকজনকে হোম কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) বাধ্য করতে পুলিশ কর্মকর্তাদের কড়াকড়ি আরোপের নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশকে কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন তিনি। এদিকে, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর আইএসপিআর বুধবার জানিয়েছে, আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে সেনাবাহিনী দেশের সব স্থানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হোম কোয়ারেন্টাইনের বিষয়টি কঠোরভাবে নিশ্চিত করবে। সরকারের দেয়া নির্দেশাবলী অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অন্যান্য দিনের মতো বুধবারও সারাদেশে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা করেছে এবং সচেতনতা তৈরিতে প্রচারণা চালিয়েছে। বলা হচ্ছে, যতদিন প্রয়োজন হবে ততদিন সহায়তা দেবে সেনাবাহিনী।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি অফিসে টানা ১০ দিনের ছুটি ছিল এর সঙ্গে যোগ হলো আরো ৭দিন। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই ছুটির মেয়াদ বাড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা জানি, ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। সশস্ত্র বাহিনী মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে মাঠে কাজ করছে। ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ওষুধ, জরুরি সেবা, জ্বালানি, শাকসবজি, মাছ, পচনশীল পণ্য পরিবহন এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে ২৪ মার্চ থেকে সশস্ত্র বাহিনী নেমেছে। মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কাজ করছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বিরামহীন কাজ করছেন। তিনি নিজেই মনিটর করছেন। দেশের সার্বিক অবস্থার খোঁজ রাখছেন। করোনায় কর্মহীনদের তালিকা তৈরি করে ত্রাণ বিতরণে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটি। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছে না। কারণ রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলিতে আড্ডা বসেছে। অনেকে অপ্রয়োজনে রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে। এভাবে আড্ডা দিতে দেওয়া যাবে না। সবাইকে যার যার ঘরে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। নিরাপত্তাচৌকিতে তল্লাশি জোরদার করে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেখতে হবে বিনা প্রয়োজনে কেউ ঘোরাফেরা করছেন কি না। একজনের সঙ্গে আরেকজনের নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ সহযোগিতা করবে। সারা দিন একস্থানে নয়, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দুস্থদের মাঝে ত্রাণ দিতে হবে।
আমাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যে সকল ব্যক্তি বিদেশ হতে মার্চ বা তার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে আগমন করেছেন তাদের অবশ্যই আলাদা থাকতে হবে, কমপক্ষে প্রয়োজনীয় সময় পর্যন্ত। কেননা তাদের মধ্যে যদি করোনা থেকে থাকে এবং তা যদি কোনও প্রকার উপসর্গ ছাড়াই থাকে তবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বা প্রতিবেশীদের মধ্যে ছড়াতে পারে এবং তাই ক্রমোন্নয়ে শত-শত, হাজার-হাজার মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। উক্ত সময়ে নাকি প্রায় তিন (৩) লক্ষ মানুষের আগমন ঘটেছে। আলাদা থাকতে যদি কেউ রাজী না হয় তবে তাদের পাসপোর্ট বাতিল করা যেতে পারে এই মর্মে সরকারী আদেশ জারি করা যেতে পারে, অথবা তারা যদি বিদেশের নাগরিক ( দ্বৈত নাগরিক) হয় তবে তাদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে পারে বলে নোটিশ প্রদান করা যেতে পারে। এই রকম কঠিন সময়ে সরকারকেও কঠিন হতে হবে।
এশিয়ার আট দেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী একটি জরুরি বিষয় এখন আমাদের সামনে। বুধবার পর্যন্ত সবশেষ তথ্য অনুযায়ী ভারতে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৩৭ জন করোনাভাইরাস সংক্রমণের শিকার হয়েছে আর মারা গেছে ৪৫ জন। এদের মধ্যে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ২৪০ জন ও মারা গেছে ১০ জন। পাকিস্তানে বুধবার পর্যন্ত ২ হাজার ৪২ জন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছে আর মারা গেছে ২৬ জন। তাদের মধ্যে নতুন করে আক্রান্তহয়েছে ১০৪ জন, কেউ মারা যায়নি। আফগানিস্তান ২২ জন নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার পর বুধবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ১৯৬ জন। আর মারা গেছে ৪ জন। শ্রীলঙ্কায় নতুন করে ৩ জন আক্রান্ত হওয়ার পর করোনাভাইরাসে আক্রান্তমানুষের সংখ্যা ১৪৬ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ২ জন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৫৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এদের মধ্যে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ৩ জন। আর একজন মারা যাওয়ায় বাংলাদেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৬ জন। অন্যদিকে মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটানে এখন পর্যন্ত যথাক্রমে ১৮, ৫ ও ৪ জন শনাক্ত হলেও এখন পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি। জানুয়ারির ২৬ তারিখ শ্রীলঙ্কায় করোনাভাইরাসের প্রথম ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি করেছিল দেশটি। সাধারণ ছুটির নামে ১৪ মার্চ থেকে প্রথম ধাপে লকডাউন। ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেন। শ্রীলঙ্কা বিদেশফেরত লোকজনকে যথাযথভাবে কোয়ারেন্টিনে নিতে পুলিশকে কার্যকরভাবে কাজে লাগিয়েছে।
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, কথাসাহিত্যিক