শিরোনাম
◈ পিআর পদ্ধতি কী, কেন প্রয়োজন ও কোন দেশে এই পদ্ধতি চালু আছে?" ◈ ইসরায়েলি হামলায় ৪৩৭ ফুটবলারসহ ৭৮৫ ফিলিস্তিনি ক্রীড়াবিদের মৃত্যু ◈ পশ্চিম তীরে দখলদার ইসরায়েলিদের সাথে তাদেরই সেনা জড়ালো সংঘর্ষে! (ভিডিও) ◈ আমদানি-রপ্তানিতে এনবিআরের নতুন নিয়ম: বাধ্যতামূলক অনলাইন সিএলপি দাখিল ◈ জুলাই স্মরণে শহীদ মিনারে ছাত্রদলের মোমবাতি প্রজ্বলন (ভিডিও) ◈ জুলাই বিদ্রোহ: কোটা সংস্কার থেকে গণঅভ্যুত্থান ◈ ভারতের বাংলাদেশ সফর নিয়ে যা বললেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল ◈ ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, ক্যাডার পদে মনোনয়ন পেলেন ১৬৯০ জন ◈ ১৮ জুলাই নতুন দিবস ঘোষণা ◈ ডিসি-এসপি কমিটি ও ইভিএম বাদ, ভোটকেন্দ্র স্থাপনে নতুন নীতিমালা জারি করলো ইসি

প্রকাশিত : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ০৭:৪৫ সকাল
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ০৭:৪৫ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আসামের ভাষা সৈনিক নিশীথ রঞ্জন দাসের বিশেষ সাক্ষাৎকার

যুগান্তর : ‘আমি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছি। মনে হচ্ছে- এটাই আমার দেশ। চারপাশে স্বজন। বিশ্বাস করুন, বাঙালি জাতির কোনো দেশ ছিল না।পাখির ভাষা আছে, আমাদের ছিল না। আমি বাংলাদেশের ভোটার নয়,তবু এ দেশ আমার আপন। এ দেশও আমার। আজ ২১ ফেব্রুয়ারি- সস্ত্রীক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সকল ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি। পুস্পাঞ্জলি দিয়েছিল। এখানে এসে শহিদদের প্রতি সম্মান জানাব, বহু যুগের স্বপ্ন ছিল। কী যে ভাল লাগছে, কী যে শান্তি লাগছে- বুঝাতে পারবো না’।

কথাগুলো বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বাংলা ভাষা সৈনিক নিশীথ রঞ্জন দাস।

তখন, দুপুর সাড়ে ১২টা। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। তখনও শ্রদ্ধা জানাতে আসা সাধারণ মানুষের দীর্ঘ লাইন।

শহিদ মিনারের পাশে তৈরি করা মঞ্চে বসে চা পান করছিলেন- ভারতের উত্তর পূর্বে অবস্থিত আসাম রাজ্যে থেকে আসা বাংলা ভাষা সৈনিক নিশীথ রঞ্জন দাশ। নিজের পরিচয় দিয়ে সাক্ষাৎকার নেয়ার অনুরোধটি করতেই- বললেন, ‘হ্যাঁ বসো, সাক্ষাৎকার নেবে? বল- কী কী জানতে চাও’..?

ভাষা সৈনিক নিশীথ রঞ্জন দাস বললেন, তোমাদের ৫২, আমাদের ৬১। বাংলা ভাষার দাবিতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল উভয় দেশের তরুণ-তরুণীরা। একই ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে, মায়ের ভাষার দাবিতে ৯ বছরের ব্যবধানে দুটি দেশে-দুটি আন্দোলন। মায়ের ভাষার জন্য, জীবন দিয়ে-রক্ত দিয়ে লড়েছেন আন্দোলনকারীরা। দুনিয়ায় এ এক বিরল ঘটনা। আসাম থেকে বাংলাদেশে ছুটে এসেছি ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন করতে- শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। বাংলাদেশের একুশে- এখন বিশ্বেও একুশে। এটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা। আমাদের- আসামবাসীদেরও একটি দিন আছে। সেটি হলো ১৯ মে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে কমলাদের আত্মত্যাগের মহান একটি দিন। ওই দিনেই বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন এগারো জন ভাষা সৈনিক। যাদের মধ্যে ছিলেন দশ জন তরুণ এবং একজন তরুণী। শহিদ কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রনাথ দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য।

মাতভাষার প্রতি সবচেয়ে সম্মান দেখাতে হবে জানিয়ে নিশীথ রঞ্জন দাস বলেন, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেই সূত্র ধরেই আসামের বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকার শিলচরে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন ১৯৬১ সালের ১৯ মে। আসামের রাজ্যভাষা হিসেবে বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে ১১টি তাজা প্রাণ নিভেছে। অবিভক্ত বাংলার সিলেট জেলার অংশ কাছাড় (শিলচর), করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিকে বাংলা থেকে বিছিন্ন করে আসাম প্রদেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়। খাঁটি বাঙালি হয়েও এপার বাংলা-ওপার বাংলা কোনো বাংলাতেই স্থান হয়নি ঈশান বাংলার বা বরাক বাঙালীর। করিমগঞ্জ, কাছাড়, শিলচর, হাইলাকান্দি নিয়ে গড়া বরাক উপত্যকা পুরোপুরি বাঙালিদের এলাকা। দেশ বিভাগের এক বছর পর রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সুরমা ভ্যালি (বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ) পূর্ব পাকিস্তনের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু বৃহত্তর সিলেটের তিন-চতুর্থাংশ নিয়ে গঠিত বরাক ভ্যালি থেকে যায় আসামে।

১৯৬০ সালের ২১ ও ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস অসমিয়াকে রাজ্য ভাষা করা নিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই সূত্র ধরেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় শুরু হয় ‘বঙ্গাল খেদাও’। বাংলাভাষীরা দলে দলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে বরাক উপত্যকা, প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপূর্বের অন্যান্য অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। ২ জুলাই শিলচরে ‘নিখিল আসাম বাংলা ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষা সম্মেলন’ ডাকা হয়। ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর রাজ্যভাষা বিল পাস হয়ে গেল আসাম বিধানসভায়। নতুন আইনে সমগ্র আসামে সরকারি ভাষা হল অসমিয়া।

শুধুমাত্র কাছাড়ে জেলাস্তরে রইল বাংলা ভাষা।বরাক উপত্যকা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠল। প্রতিবাদে ফেটে পড়ি আমরা। গড়ে তোলা হয় গণসংগ্রাম পরিষদ। প্রতিটি স্থানে শ্লোগান উঠে- ‘জান দেব, তবু জবান দেব না’। সর্বস্তরের মানুষ সেদিন ভুলে গিয়েছিল এ ছিল শুধু ছাত্রসমাজের শোভযাত্রা। যে কোনোমূল্যে মাতৃভাষা- মায়ের ভাষা রক্ষায় শপথ নেয় পুরো বরাকের বাঙালিরা। রাস্তায় রাস্তায় নামানো হলো মিলিটারি আর টহলদার বাহিনী। কিছুই আমাদের রুখতে পারেনি। জান দিয়েছি- রক্ত দিয়েছি-তবু মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছি। কথাগুলো শেষ হতেই আবারও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন নিশীথ রঞ্জন দাস।

১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইন্সটিটিউটে কাছাড় জেলা সম্মেলন আহ্বান করা হয়। সেখানে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো পরিবেশ। দাবি তোলা হল, বাংলাকে আসামের অন্যতম রাজ্য ভাষা হিসাবে মানতে হবে। ধাপে ধাপে আন্দোলন জোরদার করা হল।২৪ এপ্রিল কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বরাক উপত্যকায় দীর্ঘ পদযাত্রার আয়োজন করে।

২ মে মিছিলটি শেষ হয় শিলচওে গিয়ে। গণপরিষদ থেকে ঘোষণা করা হয়-বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে এবং অন্যান্য ভাষাগত সংখ্যালঘুদের ভাষার যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে। সেই দাবিতে ১৯ মে সকাল- সন্ধ্যা হরতাল পালনের ডাক দেয়া হয়। হরতাল সফল করতে ছাত্র সমাজের ডাকে ১৮ মে করিমগঞ্জ শহরে শোভাযাত্রা বের হয়। সেই শোভাযাত্রা রূপ নেয়-গণ-অভ্যুত্থানে।

মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার সবাই যোগ দেয়-শোভাযাত্রায়। হরতাল এবং শোভাযাত্রা বন্ধে-মোকাবেলা করতে পুরো জেলাজুড়ে নামিয়ে দেয়া হয়- পুলিশ ও মিলিটারি। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা।

১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ঘোষণা করা হয়- ট্রেনের চাকা চলবে না, বিমান চলবে না, অফিস খুলবে না। ভোররাতের দিকে আন্দোলনকারীরা রেললাইন অবরোধ করে, রানওয়ের ওপর শুয়ে পড়ে, দল বেঁধে বেঁধে জড়ো হলো বিভিন্ন অফিস আদালতের সামনে। উত্তাল হয়ে উঠলো শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, পাথারকান্দি, বদরপুর সহ গোটা বরাক উপত্যকা।ওই সময় করিমগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদের তিন নেতা রথীন্দ্রনাথ সেন, নলিনীকান্ত দাস এবং আমাকে (নিশীথরঞ্জন দাস) গ্রেফতার করা হয়।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিশীথ রঞ্জন দাস বার বার কাঁদছিলেন। বললেন, নিশ্চিত করে বলতে পারি সেই আন্দোলনে দুনিয়ার প্রথম নারী মাতৃভাষা রক্ষায় শহীদ হয়- কমলা ভট্রাচার্য। তখন তার বয়স মাত্র ১৬ বছর। তার পৈত্রিক বাড়ি ছিল আপনাদের সিলেটে। সেই দিন কমলার সঙ্গে রেললাইনের ওপর উপুড় হয়ে শুয়েও পড়ল আরও অনেকে। আচমকা পুলিশ ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

পুলিশের লাঠি আর বুটের আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীদের শ্লোগান চারদিক মুখর হয়ে। বলতে থাকে‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’, ‘জান দেবো, তবু জবান দেবো না’। পুলিশের অস্ত্রের আঘাতে আন্দোলনকারীদের শরীর রক্তাক্ত হয়ে উঠে। তারপরও আন্দোলনাকারীরা বলছিল- ‘জান দেবো- তবু জবান দেবো না’। ওই সময় পুলিশ আরও বেপরোয়া হয়ে আঘাত করতে থাকে। জ্ঞান হারিয়ে দু’একজন লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুতেই বাকিদের রেললাইন থেকে নাড়াতে পাড়েনি পুলিশ। এরপর পুলিশ মেয়েদের সম্ভ্রম হরণের জন্য আরও শক্তি নিয়ে তাণ্ডব শুরু করে। শাড়ি টেনে টেনে খুলে- রাইফেল ও বুটের আঘাতে আঘাতে আরও রক্তাক্ত করল। জ্ঞান হারিয়ে ওরা তখন বিবস্ত্রা। এমনটা বলতে বলতে, নাক-মুখ চেপে কান্না করছিলেন নিশীথ রঞ্জন দাস।

বললেন, সেই দিন পুলিশের তান্ডবে- গুলিতে ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে দিতে লুটিয়ে পড়ল ১১টি তাজা প্রাণ।আমরা বাঙালি, বাঙালিরা যেন কোনো দিন ভ‚লে না যায়, ২১’এর পাশাপাশি আমাদের আরেকটা ১৯’-ও আছে। আমার বয়স অনেক হয়েছে। ৯০ বছরেরও উপরে। জানি না আর কতদিন বেঁচে থাকব। দীর্ঘদিনের যে আশাটি ছিল- বাংলাদেশে এসে ভাষা শহীদদেও শ্রদ্ধা জানানোর- তা করতে পেরে আনন্দিত হয়েছি। যেদিকে তাকাই- মনে হয়, নিজের দেশেরই যেন আছি। চারপাশে নিজেদের লোক। স্বজনরা যেন হাঁটছে। কথা বলছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়