আহমেদ মূসা : আমাদের কালে, রাজনীতি ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ উপরিকাঠামোর সবগুলি শাখার জন্যই আমরা পেয়েছিলাম বিশাল-বিস্তৃত ক্যানভাস যা অতীতে কখনই দেখা যায়নি। ভবিষ্যতেও দেখার সুযোগ নেই; কারণ, মনীষীরা বলে গেছেন, ইতিহাসে একটি ঘটনা একইভাবে দ্বিতীয়বার ঘটে না। প্রথমবার ঘটে ঘটনা হিসেবে আর দ্বিতীয়বার ঘটে প্রহসন হিসেবে।
ঐদিন এমন মহার্ঘ ক্যানভাসেরও অল্প-অংশ মাত্র ব্যবহার করতে পেরেছেন আমাদের সৃজনশীলেরা। আমাদের কালের লেখক-শিল্পী-গবেষকসহ সৃজনশীলতার সামনে বিরাট ক্যানভাসের মধ্যে রয়েছে আয়ুব খানের মার্শাল ল’, ষাটের শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, একদলীয় শাসন, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার-পরিজনের বড় অংশের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড, জেলখানায় জাতীয় নেতৃবৃন্দের নির্মম হত্যাকাণ্ড, কয়েক দফার সামরিক শাসন, সেনা-শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সামরিক ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম, বলিদান এবং সংগ্রামসমূহের বিজয়।
আমাদের দেখতে হয়েছে পাকিস্তানী হানাদারদের এ-দেশীয় দোসর, বাংলাদেশের জন্মশত্রু, একাত্তরের ঘাতক-দালালদের হিংস্রতা ও পাশবিক উল্লাস। পাশাপাশি আমরা দেখতে বাধ্য হয়েছি স্বাধীনতার পরের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, যার শিকার হয়েছেন তৎকালীন বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মী এবং বিপ্লবী বামপন্থীরা। আমাদের বেদনার সঙ্গে দেখতে হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের কিংবদন্তির বীর সেনানী খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দার এবং ৭ নভেম্বরের পূর্বাপর সময়ে সেনাবাহিনীর অনেক অফিসারের হত্যাযজ্ঞ, কর্নেল তাহেরের জুডিশিয়াল কিলিং, পুরোনো বিমান বন্দরে ক্যু’র মোড়কে বিমান বাহিনীর বহু সদস্যের মৃত্যু, ১৯৮১ সালের মে মাসে দুই সেক্টর কমান্ডার বীর-মুক্তিযোদ্ধা বীরোত্তম জিয়াউর রহমান ও জেনারেল মঞ্জুরসহ সেনাবাহিনীর বহু সদস্যের নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং বিভিন্ন সময়ে ক্যু-পাল্টা ক্যুয়ের রক্তাক্ত অধ্যায়। দেখতে হয়েছে এরশাদ আমলে চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টা, ২০০৪ সালের একুশে আগস্টে আরেকটি নির্মম হত্যাযজ্ঞ, প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনার অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পাওয়া। দুই পর্বেই শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলির প্রায় অর্ধশত নেতা-কর্মী। জখম হয়েছেন শতাধিক।
আমরা আবার দেখেছি একই দিনে সারাদেশে বোমা ফাটিয়ে জঙ্গী-মৌলবাদীদের ক্ষমতাদখলের অভিলাষ প্রকাশ এবং সাম্প্রতিককালের জঙ্গী-মৌলবাদের সরব প্রাদুর্ভাব ও তার আন্তর্জাতিকীকরণ। আবার আমরা দেখতে বাধ্য হয়েছি ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরশাসন’, ভোটারছাড়া নির্বাচনে জিতে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে। আগুন-গুলি-গুম-তাড়িত হত্যাকাণ্ড, রক্ত-অশ্রু আমাদের দেখতেই হচ্ছে।
কিন্তু সরস্বতীর বরপুত্র আমাদের সৃজনশীলেরা দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষের প্রপঞ্চগুলি নির্মোহভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা নিজেদেরকে কেউ ভাবেন অমুকের সৈনিক, কেউ ভাবেন তমুকের সৈনিক, কিন্তু নিজেকে পূর্ণ মানুষ ভাবেন না। তারা কিছু দেখেন কিছু দেখেন না, কিছু লেখেন কিছু লেখেন না, কিছু বলেন কিছু বলেন না।
এক দল মনে করেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয় প্রকাশ করলে, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে বললে বা জঙ্গিবাদ-প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে লিখলে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইলে, এমনকি জাহানারা ইমামকে সম্মান জানালেও ‘জাতীয়তাবাদীর’ কাতার থেকে নাম কাটা যাবে। এরা এসবের ভয়ে আধা-মানব হিসেবেই কাটিয়ে দেন সময়।
আরেক দল ভাবেন, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা, ভারতের অনধিকার হস্তক্ষেপ, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতাত্তোর বাম-নিধন-বাকশাল, গুম-খুন, ভোট-জালিয়াতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে লিখলে ‘প্রগতিশীলতার কাতার’ থেকে ছিটকে পড়তে হবে, হারাতে হবে লোভনীয় উচ্ছিষ্ট।
চিন্তার এই বামনত্বের জন্যও অধুনা আমাদের কেনো কিছু বড় মাপের হয়ে ওঠে না। অথচ পদক-পদবী নিয়ে হরিলুট চলে আসছে দলান্ধদের। সারাজীবনে কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বা উদ্ধৃতিযোগ্য একটি লাইনও না লিখে এরা বিরাট ‘সুশীল-বুদ্ধিজীবী’। এরা আজকাল মধ্যরাতেও মহানগরীর রাজপথগুলিতে ‘স্কন্ধহীন ভুতের মতো’ ঘুরে বেড়ায়। বাংলাদেশের সৃজনশীল পল্লীতে এখন চলছে বন্ধ্যা সময়।
ঠিক এমন একটি সময়ে আমরা দেখি ছড়াকার আবু সালেহকে, যিনি কালের ক্যানভাসের শর্ত সবটুকু না হলেও অনেকের চেয়ে অনেক বেশি পূরণ করেছেন। তিনি একটি দলের সঙ্গেও যুক্ত, কিন্তু অনেক ন্যায্য সমালোচনা তিনি নির্ভয়েই করে থাকেন। লড়াইটা তিনি সর্ববস্থায়ই করেন মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে। এটা তাঁর অঙ্গীকারের বড় বিশেষত্ব। তিনি বোমা মেরেছেন, বোমা খেয়েছেন, বহুকাল ধরে বহন করে আসছেন ক্ষত-ব্যাধি। কিন্তু কখনো সাহস হারাতে দেখিনি তাঁকে।
বাংলাদেশে, আমাদের কালের প্রধান কবিদের মধ্যে রয়েছেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ প্রমুখ। আর, আমাদের অনন্য ছড়াকারদের মধ্যে অন্যতম একজন আবু সালেহ। তার ছড়া একাধারে সাহিত্যের ছড়া, গণছড়া, প্রতিবাদের ছড়া, সাহসের ছড়া। তার ছড়া থেকে তৈরি হয় স্লোগানও। তাঁর জন্মদিনে হাতে-হাতে আমার উপহার দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অতি দূর থেকে একটি আবদার জানাই, ‘বাহুল্য বিষয় বা তুচ্ছ লোকদের তিরস্কারের জন্য আপনার ছড়ার যেন অপচয়-অসম্মান না হয়’।
সালেহ ভাইয়ের ছড়ার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছে ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা, রক্ত দিয়ে কিনলাম শালার এমন স্বাধীনতা...।’ কিন্তু আমার কাছে বেশি ভালো লাগে যেটি, সেই ছড়ার প্রথম চার লাইন দিয়ে শেষ করলাম:
‘চিরকালের খোকারে তুই, চিরকালের খোকা।/সবাই হলো চালাক-চতুর তুই রইলি বোকা।/তোর হাতে দেয় মুড়কি মোয়া/তোর গালে দেয় চুম,/যে-চোখ দিয়ে দেখবি জগৎ সেই চোখে দেয় ঘুম...
নিউ ইয়র্ক, ১৭ জুলাই, ২০১৯।
সম্পাদনা : মহসীন/মারুফ