আমিন মুনশি : ফেরেশতাদের সৃষ্টি করা হয়েছে নূর দিয়ে। তারা অদৃশ্য জগৎ এবং মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনে সর্বদা রত থাকেন। আল কোরআনের ভাষায় ‘তারা আল্লাহ তায়ালা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে।’ (সূরা: তাহরীম, আয়াত: ৬) তারা শুধুমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি এবং যেকোনো প্রকার পাপ, হিংসা, লোভ-লালসা, ঘুম যাবতীয় কিছু তাদের স্পর্শ করতে পারে না। হাশরের ময়দানে এ ফেরেশতাদের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ বান্দার ভালো ও মন্দ কাজের সাক্ষ্য নেবেন। আর তাই তিনি ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকে ঈমানের অংশ নির্ধারণ করেছেন। তাই ‘ফেরেশতারা মহান আল্লাহর অনুগত সৃষ্টি’ অন্তরে এ বিশ্বাস রাখা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক কর্তব্য।
ইসলামের আকিদা অনুসারে ফেরেশতারা স্বর্গীয় দূত। তারা দিনরাত ক্লান্ত না হয়ে মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করেন এবং মহান রাব্বুল আলামীনের অবাধ্য হবার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। ফেরেশতারা খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করেন না। তারা পবিত্র স্থানে অবস্থান করেন। যেকোনো স্থানে গমনাগমন ও আকৃতি পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন। ফেরেশতাদের মাঝে লিঙ্গ বৈষম্য নেই। তারা নারীও নয় আবার পুরুষও নয়। মক্কার মুশরিকরা ফেরেশতাদেরকে ‘আল্লাহর কন্যা’ বলে বিশ্বাস করতো। এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘তোমাদের পালনকর্তা কী তোমাদের জন্যে পুত্র সন্তান নির্ধারিত করেছেন এবং নিজের জন্যে ফেরেশতাদেরকে কন্যারূপে গ্রহণ করেছেন? নিশ্চয় তোমরা গুরুতর গর্হিত কথাবার্তা বলছো।’ (সূরা: আল-ইসরা, আয়াত ৪০)
ফেরেশতাদের প্রকৃত গঠনগত রুপ কেমন তা একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালাই জানেন। তবে তারা মানুষের আকৃতি ধারণ করতে সক্ষম। হজরত জিবরাইল (আ.) সম্পর্কে এতোটুকু জানা যায়, তার ৬৫০টি পাখা আছে। আবার রাসূল (সা.)-এর যখন সিনাহ পবিত্র করা হয়েছিল তখন হজরত জিবরাইল (আ.) সাদা কাপড় পড়া মানুষের আকৃতি ধারণ করে এসেছিলেন। যখন রাসূল (সা.)-এর নিকট ওহী নিয়ে আসতেন তখন বেশির ভাগ সময় সাহাবি দাহইয়াতু কাবলী (রা.)-এর রূপ ধারণ করে আসতেন। সুতরাং বলা যায়, ফেরেস্তাদের নির্দিষ্ট কোনো রূপ নেই। মহান আল্লাহ তায়ালা যখন যে রূপ ধারণ করতে বলেন তারা তখন সেই রূপই ধারণ করেন।
ফেরেশতাদের মধ্যে চারজন প্রধান ফেরেশতা আছেন যারা মহান আল্লাহ পাকের আদেশে বিশেষ বিশেষ কাজে নিবিষ্ট আছেন। (১) হজরত জিবরাঈল (আ.)। তাকে সকল ফেরেশতাদের সর্দার বলা হয় এবং তিনি ওহি নাজিল করার দায়িত্বে ছিলেন। (২) হজরত ইসরাফীল (আ.)। তার দায়িত্ব হলো, মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে কিয়ামতের দিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া। হজরত ইসরাফিল (আ.)-এর শিংগায় ফুৎকার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিয়ামত সংঘটিত হবে। (৩) হজরত মিকাঈল (আ.)। তার কাজ হচ্ছে বৃষ্টি বর্ষণ, উদ্ভিদ উৎপাদন প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত থাকা। এছাড়াও বজ্রপাত ঘটানোর কাজও হজরত মিকাঈল (আ.)-এর হাতে। (৪) হজরত আজরাঈল (আ.)। যিনি মালাকুল মওত নামেও পরিচিত। মহান আল্লাহ পাকের আদেশে প্রাণীকূলের জান কবজের কাজে তিনি নিয়োজিত।
এই চারজন ব্যতীত সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালা অগণিত ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন। তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো কাজে দায়িত্বরত রয়েছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে যাদের কথা সচরাচর আলোচনা হয়ে থাকে তারা হলেন- (১) হামালাত আল-আরশ; যে সমস্ত ফেরেশতা মহান আল্লাহর আরশ ধরে রাখে, মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনুল মাজীদে বলেন যে, ‘(কিয়ামতের দিন) ফেরেশতারা আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে। সেদিন আটজন ফেরেশতা তোমার রবের আরশকে ধারণ করবে তাদের ঊর্ধ্বে।’ (সূরা: হাক্কাহ, আয়াত: ১৭)
(২) সাতটি বেহেশতের ফেরেশতাগণ। (৩) হাফাজা বা তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাগণ। (৪) মুনকার ও নাকীর: কবরে প্রশ্নকারী ফেরেশতাদ্বয়। (৫) দারদায়িল। (৬) মালিক; জাহান্নামের তত্ত্বাবধানকারী ফেরেশতা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ। আল্লাহ তায়ালা তাদের যা আদেশ করেন, তারা তা অমান্য করেন না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে।’ (সূরা: তাহরিম, আয়াত: ৬)
(৭) রিজওয়ান; জান্নাত বা স্বর্গ তত্ত্বাবধানকারী ফেরেশতা। (৮) নিয়ম-শৃঙ্খলা পালনকারী ফেরেশতাগণ। (৯) এছাড়াও বিশেষ দুজন ফেরেশতা কিরামুন ও কাতিবীন প্রতিজন মানুষের ভালো-মন্দ কাজের হিসাব রাখেন। পবিত্র কোরআন মাজীদে বলা আছে, ‘স্মরণ করুন! দুই ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’ (সূরা: কাফ, আয়াত: ১৭-১৮)
পবিত্র কোরআনুল মাজীদে ফেরেশতাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ আরও বলেছেন যে, ‘ফেরেশতাদের অস্তিত্ব রয়েছে, তারা আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন ও পরিচালনাধীন। ‘তারা তার আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলে না, তার নির্দেশেই তারা কাজ করে যায়।’ (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ২৬-২৭) ‘তোমাদের ওপর নিযুক্ত রয়েছে তত্ত্বাবধায়করা (ফেরেশতারা), যারা সম্মানিত লেখক। তারা তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত।’ (সূরা: ইনফিতার, আয়াত: ১০-১২)