শাহিন আখতার : যে বর্ণমালার জন্য রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন, রক্তগঙ্গা দেখেও পালিয়ে আসেননি প্রিয় বর্ণমালাকে ছেড়ে, এই ভাষার মাসে সেই বর্ণমালার নৈবেদ্য সাজিয়ে আপনাকে শ্রদ্ধা জানাই হে অকুতোভয় লড়াকু বীর সৈনিক মোহাম্মাদ সুলতান, যিনি সম্পর্কে আমার চাচাশ্বশুর। আজ তাঁর সম্পর্কে কিছু লিখতে এসেছি।
মৌলভী শমসের আলী আহমেদ ও গুলজান নেছার কোল আলো করে ১৯২৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার মাঝগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ সুলতান।
তাঁর পিতা ১৯১৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে পুলিশের এস.আই হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে উ.ঝ.চ হিসেবে উন্নীত হন। পাঁচ ভাই ও তিন-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম।
মাত্র ছয় বছর বয়সে মাকে হারিয়ে সৎমায়ের বৈরী পরিবেশে বড় হলেও কখনও কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। অথচ চাইলেই বিলাসী জীবন যাপন-করতে পারতেন অনায়াসে। তিনি অবশ্য বিলাসী ছিলেন একটি ক্ষেত্রে, তা হলো দেশকে ভালবাসার ক্ষেত্রে।
এ-সম্পর্কে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ডায়রীতে লিখেছিলেন “ইতিমধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে চতুর্দিকে। নবম শ্রেণির ছাত্র আমি। যশোর জিলা স্কুলের গাড়ি-বারান্দা সংলগ্ন। শ্রেণিতে বসে কী যেন পড়ছিলাম। রাস্তা থেকে তীব্র তীক্ষè কণ্ঠে শ্লোগান ভেসে এলো। জানতে পারলাম কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্টের বিরোধী ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ পুলিশ। যশোরের খড়কীর পীর সাহেবের ছেলে আবদুল হক সাহেব এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র আবদুল হক দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। দেশমাতৃকার প্রতি অসীম শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে পড়লো।আমিও কি দেশকে ভালবাসতে পারি না? এরপর দীর্ঘদিন চর্চা করেছি, অনুশীলন করতে চেয়েছি, দেশের মাটিকে আমিও ভালবাসতে চাই। দেশকে ভালবাসতে হলে নাকি অনেক কষ্ট করতে হয়, অনেক সহিষ্ণু হতে হয়। তাই শুরু হল সাইকেল চালনা। দীর্ঘ পদযাত্রা বা লম্বা দৌড়। সাইকেলে করে প্রতিদিনই খাজুরা বা ঝিকরগাছা যেতাম। পায়ে হেঁটে যশোর রথকে খুলনা মাগুরাা গিয়েছি। না খেয়ে থাকার অভ্যাস করেছি। কলকাতায় পুরো এক মাস দু-পয়সার পাউরুটি আর দু-পয়সার বুন্দিয়া খেয়ে কাটিয়েছি। হক ভাইয়েরা রাজনীতি করেন কিন্তু রাজনীতি কী, জানি না। তারা নাকি মানু কে খুব ভালবাসেন কিন্তু কিভাবে তার বহিঃপ্রকাশ হয়, জানি না। আমাকেও জানতে হবে। কিন্তু কোন পথে?
মোহাম্মদ সুলতান ঠিকই দেশকে ভালবাসার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। দেশমাতৃকার প্রয়োজনে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রথম অবস্থান ধর্মঘটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দাঙ্গাবিরোধী মিছিলেও তিনি হাতে হাত রাস্তায় ছেলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবেতন বৃদ্ধির প্রতিরোধ আন্দোলনে রেজিস্ট্রার অফিসের সামনে পিকেটিং করেছিলেন। পঞ্চাশের শীতের রাতগুলোতে চাদরের নীচে করে ইকবাল হল ব্যারাকের ঘরগুলোর সামনে দরজার কপাটের নীচে সবার অলক্ষ্যে নাচোলে সশস্ত্রবাহিনীর বর্বর অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখা প্রচারপত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৪৮ থেকে ভাষার দাবিতে যে সব আন্দোলন হয়েছে, তার অন্যতম সংগঠক হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। বাহান্নর ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে বসে যে ১১জন ছাত্রনতা ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ধারা ভাঙার পক্ষে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন, তাদের মধ্যেও তিনি ছিলেন অন্যতম। একুশের ভোরে মধুর কেন্টিনে বসে তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু গাজীউল হক সিগারেটের খালি প্যাকেট কুড়িয়ে তাতে দু’তিনটি চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হবার অনুরোধ জানিয়ে। ১৪৪ধারা ভেঙে সত্যাগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেবার পর তিনি কাগজ কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় গেটের পাশে প্রত্যেক সত্যাগ্রহীর নাম লিখে নেবার জন্য।
২২ ফেব্রুয়ারি ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে নিজ হাতে কালো পতাকা উড়িয়েছিলেন ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে। তারপর মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে সভাশেষে আবার মিছিলে গিয়েছিলেন লাখো জনতার সাথে।
বাহান্নের অগ্নিঝরা দিনে তিনি তৎপর হয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নকে গড়ার কাজে। ১৯৫৩ সালে তিনি প্রথম সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন।
দেশের প্রথম প্রগতিশীল প্রকাশনী পুঁথিপত্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৫৩সালে এখান থেকেই তাঁর ও কবি হাসান হাফিজুরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের প্রথম ঐতিহাসিক সংকলন ‘একুশেফেব্রুয়ারী’। যদিও প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই তা বাজেয়াপ্ত হয়।
আত্মপ্রচারবিমুখ এই মানুষটি সারা জীবন ধরে ধূপের মতো পুড়ে অন্যের জন্য গন্ধ বিলিয়েছেন। চাননি কোনো প্রতিদান, গ্রহণ করেননি কোনো সুযোগ-সুবিধা। যখন তিনি জীবনের শেষ দিনগুলোতে হাসপাতালে ছিলেন, তখনও নয়। তাঁর বন্ধু বান্ধবরা অনেকই ছিলেন মন্ত্রীসভার সদস্য, যারা তাঁর জন্য কেবিনের ব্যবস্থা করেছিলেন। গরিব-দুখির কথা চিন্তা করে তিনি তাও গ্রহণ করেননি। তিনি জানিয়ে দেন ঐ টাকা অন্য কোনো দুঃস্থ রোগীর জন্য ব্যয় করলে সুখী হবেন। ১৯৮৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর হাসপাতালের করিডোরে এই মহান নির্লোভ মানুষটি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলা হারান এক প্রকৃত বাংলাদরদীকে। যদিও তাঁকে মূল্যায়ন করতে পারেননি কৃপণ এই দেশ, পারেননি রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করতে; যদিও ভালবাসায় বিনিময়ের কোনো প্রত্যাশা রাখতে নেই কথাটিতেই তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।