শিরোনাম
◈ লটারিতে নির্ধারিত ৬৪ জেলার এসপি: সুষ্ঠু নির্বাচনে সরকারের নতুন উদ্যোগ ◈ মোহাম্মদপুরে ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা, বাবা গুরুতর আহত ◈ জাতীয় অর্থনীতি ও কৌশলগত সম্পদে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার শুধু জনগণের নির্বাচিত সরকারের: তারেক রহমান ◈ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ সম্পর্কে যা বললেন আইনজীবী পান্না ◈ দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু বিপর্যয়ের সতর্কবার্তা: ৯০% বাংলাদেশি উচ্চ ঝুঁকিতে ◈ নতুন আইনে বাতিল হচ্ছে অসংখ্য দলিল, রয়েছে জেল ও অর্থদণ্ড ◈ পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল: পাসপোর্টের নতুন নিয়মে চমক ◈ আনন্দ বেদনার নারী কাবাডি বিশ্বকাপের পর্দা নাম‌লো ◈ মব ভাইরাসের তাণ্ডবে অতিষ্ট দেশ: ইসলামী বক্তা তাহেরী (ভিডিও) ◈ অনলাইন মার্কেটপ্লেসে নতুন দিগন্ত: অ্যামাজন-ইবে হয়ে রপ্তানির অনুমতি দিল বাংলাদেশ ব্যাংক

প্রকাশিত : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ০২:৪১ রাত
আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ০২:৪১ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ক্ষমা প্রার্থনায় জামায়াতী অনীহার স্বরূপ-অন্বেষা

আহমেদ মূসা : জামায়াতে ইসলামী এমন একটি দেশে দোর্দন্ড-প্রতাপে বিরাজ করছে যে দেশটি তারা চায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-বিরোধীদের অন্যতম পুরোধা হয়েও জামায়াতে ইসলামী এদেশে রাজনীতি করছে, প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে এনজিও-ওর মতো, অবাধে ব্যবসা করছে, দায়ে পড়লে বিদেশি লবিস্টও নিয়োগ করছে। কিন্তু আপত্তি তাদের একটামাত্র জায়গায় একাত্তরে তাদের কৃতকর্মের জন্য, অন্যায়-অপরাধ-পাপ ও ভুলের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনায় ও ভুল স্বীকারে। জনগণের কাছে ভোট চাইতে তাদের লজ্জা করে না, লজ্জাটা শুধু ভুলের প্রায়শ্চিত্র বা ক্ষমার মাধ্যমে মুমিন বান্দা হওয়ার ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমা করুক আর না করুক, দেশ ও জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া ছিল অত্যাবশ্যকীয়। দেরিতে হলেও দলের শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা ড. রাজ্জাক এবং তার অনুসারীরা বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন, কেউ কেউ দলত্যাগও শুরু করেছেন। দুইজনের কথা প্রকাশ্যে এলেও তৃণমূল পর্যায়ে দলত্যাগ ও নিষ্ক্রিয়তা শুরু হয়েছে অনেক আগেই।

একাত্তরে তাদের কৃতকর্মের জন্য জামায়াতে ইসলামীর ভুল স্বীকার না করার সরল অর্থ হচ্ছে, তারা তাদের তখনকার অবস্থানকেই সঠিক মনে করে। এর আরো সরল অর্থ হচ্ছে, সুযোগ পেলে বা ক্ষমতায় যেতে পারলে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে আবার একীভূত হবে বা বাংলাদেশকেই পাকিস্তান-আদলের আরেকটি দেশে রূপান্তরিত করবে। অবশ্য বাংলাদেশে জামায়তে ইসলামীর ক্ষমতায় যাওয়ার আশঙ্কা শূন্যের কোঠায়, যদিও জামায়াত মনে করে সেটা সম্ভব। এমন কি ২০০৮ সালে জামায়াতের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ঘোষণাও দিয়েছিলেন, যে ১৫ বছরের মধ্যে তারা ক্ষমতায় আসবেন। এসবেরও সরলতম অর্থ হচ্ছে, তারা বাংলাদেশের মানুষকে বোকা ছাড়া আর কিছু ভাবেন না। অথচ, জন্মের পর থেকে এই দলটিই চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা, নিষ্ঠুরতা, প্রতারণা, হঠকারিতা ও গোয়ার্তুমির পরিচয় দিয়ে আসছে।

অন্যদিকে, পৃথিবীতে বাংলাদেশের জনগণকেও একটা নজিরবিহীন দুর্ভাগ্য বহন করতে হচ্ছে। বলীয়ান আতত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়লাভ করেও পরাজিত-বিশ্বাসঘাতক-শত্রুদের দম্ভ সহ্য করতে হয় তাদের। করতে হয় এদের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম। আরো দুর্ভাগ্য, দলীয় স্বার্থের কারণে সেই পরাজিতদের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন সমঝোতা করতে হয় মূলধারার দলগুলিকে, পেশাজীবী সংগঠনগুলিকে। স্বাধীন দেশের পাতাকাও ওড়ে তাদের গাড়ি-বাড়িতে। কখনো কখনো তাদের দম্ভ আকাশচুম্বীও হয়ে ওঠে, ছাড়িয়ে যায় সহ্যের মাত্রা।

স্বাধীনতার পর জামায়াতসহ ধর্মাশ্রয়ী দলগুলিকে প্রথম নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু একসময় সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল গঠন করায় ধর্মাশ্রয়ী দলগুলিকে নিষিদ্ধের আলাদা-গুরুত্ব হারিয়ে যায়। জিয়াউর রহমানের আমলে পিপিআর-এর আওতায় আবার সবগুলি দল পুনরুজ্জীবিত হয়। জামায়াত তখন বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের লেবাস নিয়ে কাজ শুরু করে। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলি থেকে আসা অঢেল অর্থ ব্যয় করে তারা গ্রহণ করে সুদূর-প্রসারী কর্মসূচি। দরিদ্রের মেধাবী সন্তানদের স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ পর্যন্ত আর্থিক সাহায্য করে সামরিক-বেসামরিক অনেক উচ্চ ও অন্যান্য পদে অনুপ্রবেশ ঘটায়। আজকে আমরা শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল প্রভৃতির মধ্যে বিপুল-সংখ্যক জামায়াত-শিবির করার যে চিত্র বিষ্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, এটা জামায়াতের সুদূর-প্রসারী কর্মসূচির পেকে-যাওয়া ফল। বিশাল মূলধনের অংশ-বিশেষ দিয়ে তারা কব্জা করে সেবাখাতগুলিও। তাদের কর্জে হাসানার সূক্ষè বেড়াজাল ঘিরে ফেলে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। এরসঙ্গে মিশেল দেওয়া ধর্ম-ব্যবসাতো আছেই।

জামায়াত ধরে নিয়েছিল, প্রচুর অর্থ ছিটানোর পাশাপাশি মূলধারার দলগুলির সঙ্গে সখ্যতা সৃষ্টি বা তার রদবদল করে ও পর্যায়ক্রমে কর্মসূচি অনুসরণের মাধ্যমে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। তারপর একসময় বড় জায়গা করে নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় চলে আসবে। এই চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির ওপর জামায়াত খুব বেশি নির্ভর করায় একাত্তরের ভূমিকার জন্য ভুল স্বীকার বা ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। গোটা এরশাদ আমল ও ছিয়ানব্বইয়ে বিএনপি-বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগকে অনুসরণ করায় তাদের নৈতিক বা রাজনৈতিক সঙ্কট তেমনভাবে দেখা যায়নি। চলতি পর্বে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করার পাশাপাশি তাদের প্রাণ-ভোমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলি থেকে একপ্রকার উচ্ছেদ করে প্রায়-মিসকিনে পরিণত করেছে। জান-মাল ধরে একসাথে টান দিয়ে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে। এ কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রায়-একক উদ্যোগ-সাহসের জন্য সম্ভব হতে পেরেছে। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে এটা সম্ভব ছিল না। এতে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবেও বিপুল লাভের মুখ দেখেছে। দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, বিএনপি ও জামায়াতকে পাটের একগাছিতে মুড়ে কঠিন এক দড়ি পাকিয়ে বিএনপিকেও ফেলেছে ভয়াবহ বিপর্যয়ে। অন্যদিকে জামায়াত এবং বিএনপির ভেতরকার ছদ্মবেশি-জামায়াতিরা মিলে রাজপথের দল বিএনপিকে প্রথমে ঢুকিয়েছিল কানাগলিতে, তারপর টানছিল কসাইখানার দিকে। জামায়াতকে ক্ষমতায় নেওয়ার আগে দ্বিতীয় রাজনৈতিক শক্তি করার পরিকল্পনাও চলছিল সমান্তরালভাবে। সে বিতর্ক ভিন্ন। আমাদের চলতি প্রসঙ্গ জামায়াতের ক্ষমা প্রার্থনা ও ভুল স্বীকার নিয়ে।

আশির দশকের শেষভাগে একবার জামায়াত একাত্তরের ভূমিকার জন্য ভুল স্বীকার করে গণ-তওবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে কানাঘুষা চলছিল। এনিয়ে আমি একটি প্রতিবেদনও করেছিলাম সাপ্তাহিক আগামী বা একই ভবনের তারকালোক পত্রিকায়। অধুনা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক মইনুদ্দিন নাসের এ ব্যাপারে বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু জামায়াত সেই চিন্তা থেকে সরে আসে। অবশ্য আমার প্রতিবেদনের প্রতিবাদও তারা করেননি। কিছুদিন পর এ ব্যাপারে ছাত্র শিবিরের একজন প্রভাবশালী নেতাকে জিজ্ঞেস করায় তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন তার সারমর্ম হচ্ছে, ভুল স্বীকার বা ক্ষমা চাইলে একাত্তরে তাদের যে-সব লোকের প্রাণ গেছে (তাদের ভাষায় ‘শহীদ’ হয়েছে) তাদের প্রতি ‘অন্যায়’ করা হবে। এই জবাবের মধ্যেও নিহিত দেখতে পেয়েছিলাম বাংলাদেশকে মেনে না নেওয়ার ঔদ্ধত্য। এই ঔদ্ধত্যও তাদের সংকটের অন্যতম কারণের একটি।

বাংলাদেশে জামায়াত-বিরোধী সূচনা-আন্দোলন একক কোনো বা কারো পরিকল্পনার ফসল নয়। বরং জামায়াত নেতাদের ঔদ্ধত্যই বড় দুইটি আন্দোলনকে ডেকে এনেছিল। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বাপর সময় ধরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে অনেক লিখেছি। পরিশ্রম লাঘব ও পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা হ্রাসের জন্য এই লেখায় আমি আমার আগের কিছু লেখার উদ্ধৃতি দেব। এতে আমার এই সংক্ষিপ্ত লেখার বিভিন্ন প্রসঙ্গ সম্পর্কে কেউ বিস্তারিত জানতে চাইলে উৎসগুলি তাদের উপকারে আসবে। সবগুলি লেখাই ঢাকার অনলাইন ও মুদ্রিত দৈনিকসহ নিউইয়র্কের বেশ কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়। পরবর্তীকালে আমার কলাম-ভিত্তিকগ্রন্থ ‘যেমন দেখেছি ওয়ান ইলেভেন’ ও সবশেষে ‘ধেয়ে আসছে নন্দে মাতরম্ এবং অন্যান্য নির্বাচিত কলাম’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছি।

‘১৯৮১ সালের ২৮ মার্চ জামায়াত নেতারা প্রথম সংবাদ সম্মেলনে দম্ভোক্তি করেন, যে ১৯৭১ সালে তারা কোনো ভুল করেননি এবং বাংলাদেশের কনসেপ্ট সঠিক ছিল না। গোলাম আযমও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে একই কথা বলেন। এই বক্তব্যের পর দেশে জামায়াত-শিবির-বিরোধী প্রচন্ড ক্ষোভ তৈরি হয়। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্বে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।

কয়েকটি পত্রিকাও এগিয়ে আসে সোচ্চার ভূমিকা নিয়ে। দাবি ওঠে অবৈধ নাগরিক ও যুদ্ধাপরাধেযুক্ত গোলাম আযমের বিচারের। কেউ কেউ দাবি তোলেন গোলাম আযমকে বহিষ্কারের ।

‘১৯৮০-র দশকের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মূল নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রভাবিত মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ ও জাসদ প্রভাবিত মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদসহ কিছু সংগঠনের প্রয়াসে গড়ে উঠেছিল যুদ্ধাপরাধী এবং স্বাধীনতা-বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন।

‘মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে গোলাম আযম পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতা ও পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছিলেন তা-ই শুধু নয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিদেশে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে চেয়েছেন। এসব কারণে বাংলাদেশে তার নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়।

১৯৭৮ সালে গোলাম আযম পাকিস্তানি নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশের ভিসা নিয়ে এ দেশে আসেন অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে। তার ৬ মাসের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি আর পাকিস্তানে ফিরে যাননি। এ দেশে থেকে যান এবং একাত্তরে তাদের অবস্থানই সঠিক ছিল বলে প্রচারণা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেন অন্যদের। এটাও ছিল এক ধরনের উষ্কানী (নিষ্প্রাণ অক্ষর যখন মশাল : ‘ধেয়ে আসছে নন্দে মাতরম্ এবং অন্যান্য নির্বাচিত কগলাম’)।

‘গোলাম আযম বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে মুসলিম দেশগুলিকে প্রভাবিত করার কাজে লিপ্ত থাকেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের’ বৃথা-অপচেষ্টাও করেন অনেকদিন ধরে। ৭২ সালে তার নেতৃত্বে পাকিস্তানে পালিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার’ সপ্তাহ।

‘জামায়াত-শিবির বিরোধী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বও শুরু হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর উস্কানীতে। জামায়াত ১৯৯১ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত অধ্যাপক গোলাম আযমকে দলের আমির নির্বাচন করে। গোলাম আযম তখন পাকিস্তানি নাগরিক। এই পদক্ষেপ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ¡াসী জনগণকে শুধু অপমানই নয়, বাংলাদেশের সংবিধানেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ, কোনো বিদেশি নাগরিকের বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান ব্যক্তি দূরে থাকুক, কর্মী হওয়ারও সুযোগ নেই।

‘প্রতিবাদ করার জন্য ডিসেম্বরের ২৯ তারিখে কাজী নূর-উজ্জামান সভা আহবান করলেন তার বাসায়। গিয়ে দেখি অনেক মানুষ। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র, নয়া পদধ্বনি এবং ৮০-৮১ সালের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জামায়াত-শিবির বিরোধী আন্দোলনে জড়িত অনেকেই উপস্থিত। কথা উঠল প্রতিবাদ-প্রতিরোধে নামার জন্য বড় সংগঠন করার। একেক জন সংগঠনের নাম প্রস্তাব করতে থাকেন। নির্মূল কমিটি নামটি লুফে নেন কাজী নূর-উজ্জামান। ..গঠন করা হয় আমাকেসহ ১০১ সদস্যের নির্মূল কমিটি। এই আন্দোলনের শুরুর দিকে বিএনপি এবং ছাত্রদলের অনেকেও সমর্থন করেছেন। কিন্তু মার্চে গণআদালত গঠনের পর বিএনপির সমর্থকেরা সরে পড়ে।’

(বাংলাদেশের জন্ম-শত্রু প্রতিরোধ আন্দোলনের অনুক্ত কথা : প্রাগুক্তগ্রন্থ)।

‘স্বদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা আর রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মধ্যে তফাত আকাশ-পাতাল। বাংলাদেশে কেউ গণতন্ত্র চান, কেউ সমাজতন্ত্র চাইতে পারেন, কেউ ইসলামী ব্যবস্থাও দাবি করতে পারেন। এগুলি রাজনৈতিক অধিকার, রাজনৈতিক মতপার্থক্য। কিন্তু একাত্তরে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে বেঈমানী করেছে, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা-লুটতরাজ-ধর্ষণে শত্রুবাহিনীকে সহায়তা করেছে বা নিজেরা সে-সব অপকর্ম করেছে, তারা গুরুতর অপরাধী। কিন্তু এখন বিষয় দুটিকে গুলিয়ে ফেলার একটা প্রচারণা চলছে দেশে-বিদেশে। এই প্রচারণা বিশেষ করে চলছে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বিতর্কিত ও লঘু করে দেখানোর জন্য। কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীও কৌশলে এহেন মতলবপূর্ণ প্রচারণা চালাচ্ছেন। কেউ কেউ ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন যে, ওরা ‘আদর্শিক কারণে পাকিস্তান রক্ষা’ করতে চেয়েছে ইত্যাদি.....।

‘যুদ্ধবন্দি এবং যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যেও রয়েছে বিশাল ফারাক। অনেকে আজকাল এই ব্যাপারটাও গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। উদ্দেশ্য অভিন্ন। একাত্তরে যুদ্ধবন্দি ছিল ৯৫ হাজার। আর পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী ছিল ১৯৫ জন, যদিও তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল চুক্তির কারণে। যুদ্ধবন্দি ও যুদ্ধাপরাধীর বিষয়টি ভালো করে খোলাসা করেছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। আমেরিকার স্বাধীনতার পর তিনি বলেছিলেন, ধৃত বৃটিশ সৈন্যরা যুদ্ধবন্দি। তারা প্রয়োজনে উদারতা পাবে। কিন্তু স্বদেশের বিশ্বাসঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি ভোগ করতে হবে।’

(সফেদ সত্যের বিরুদ্ধে রঙিন প্রচার : প্রাগুক্তগ্রন্থ)।

‘জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত হলেও বৃহৎ অর্থে এটি একটি এনজিও। চাকরি ও ঋণ দিয়ে তারা অধিকাংশ কর্মীকে বেঁধে রেখেছে। ইসলামী ব্যাংকের ব্যবসাপাতি, ইসলামী হাসপাতালের যন্ত্রপাতি বা কোচিং সেন্টারের গাইড বইয়ের মতো ইসলামও তাদের কাছে রাজনৈতিক হাতিয়ার বই কিছু নয়। সে কারণে ক্ষমতার জন্য আওয়ামী লীগের পদাঙ্ক অনুসরণে যেমন তাদের আপত্তি নেই, তেমনি আপত্তি নেই বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনে। আবার চিরবৈরী কওমী-ওয়াহাবীদের সঙ্গ পেতে বা তাদের ব্যবহার করতেও আপত্তি দেখা যাচ্ছে না। এককালের বহু কমিউনিস্ট-বামকে খাম সরবরাহেও তাদের দ্বিধা নেই। একটি রাজনৈতিক দল এনজিও হয়ে পড়লে তার সামনে বহু সীমাবদ্ধতা উপস্থিত হয় এবং ক্রমনিঃস্বায়নের দিকে যেতে থাকে। বাংলাদেশে জামায়াতের ঘাঁড়ে আছে আরো অনেক বড় বোঝা, যুদ্ধাপরাধীদের বোঝা। এ বোঝা অতিশয় ভারী যা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসেও নাড়াতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা, যে দলের কর্মীদের উত্তেজিত করতে চাঁদে মুখ দেখতে পাওয়ার গুজব ছড়াতে হয় কিংবা কাবা শরীফের গিলাফ নিয়ে জালিয়াতি করতে হয় সে দল পানি ঘোলা থাকা পর্যন্তই সজীব থাকতে পারে, সব সময় নয়।’ (মোমের আগুনে দাবানলের উত্তাপ : প্রাগুক্তগ্রন্থ)।

আজকে জামায়াত তার ইতিহাস ও নিয়তি-নির্দিষ্ট ভাগ্যকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছে। তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত যা-ই থাক, সবার আগে প্রয়োজন তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা। ভুল স্বীকার করা। এ দাবি এতোদিন বাইরের লোকেরা করেছেন। এবার দাবি উঠছে দলের ভেতর থেকেও। এই দরকারী দায়িত্বটি পালন না করে জামায়াতীরা নতুন নামে দল করলেও একাত্তর চিরকালই তাদের তাড়া করে বেড়াবে। দেশপ্রেমিক জনগণ এদের অস্তিত্ব দেখলে অপমান বোধ করবেন। নাম পরিবর্তন করে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশ জামায়াতি ইসলামী হয়ে বা ছাত্র সংঘ থেকে ছাত্র শিবির হয়েও ইতিহাসের জেরা ও ধাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়নি, এটা স্মরণ রাখা প্রয়োজন।

২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। বাংলাদেশ প্রতিদিন উত্তর আমেরিকা সংস্করণ।

আহমেদ মূসা লেখক-সাংবাদিক-নাট্যকার। সাপ্তাহিক বর্ণমালার উপদেষ্টা সম্পাদক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়