হাসিনা আক্তার, লন্ডন থেকে : বোরকা নিয়ে মন্তব্য করে আলোচনার ঝড় তুলেছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি বোরকাকে লেটার বক্স এবং ব্যাংক ডাকাতের সাথে তুলনা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ইসলামপন্থী উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তুলবে বোরকা, মুখের যে অংশ চোখের আড়াল করে রাখে সে অংশকে বলে নিকাব। বিষয়টি নিয়ে তুমুল প্রতিবাদের মুখে পড়েন বরিস জনসন, দাবী উঠেছিলো তাকে প্রকাশে ক্ষমা চাইতে হবে এবং কনজারভেটিভ পার্টি থেকে বের করে দিতে হবে।
পুরো ব্রিটেন জুড়ে রয়েছে হিজাবের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। কোনো কোনো জায়গায় সরাসরি বন্ধ আবার কোথাও শিথিল। পর্দার বিষয়টি নিয়ে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে রয়েছে ব্যাপক বির্তক। এছাড়া বহুসংস্কৃতির বিষয়ে রয়েছে বিভিন্ন মতপার্থক্য এবং রাজনৈতিক মহলে রয়েছে বহু আলোচনা। আরো বির্তক রয়েছে ধর্মীয় স্বাধীনতা, মহিলাদের সমতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য নিয়ে।
পুরো ইউকে এবং ইউরোপ জুড়ে হিজাব নিয়ে যতই মতপার্থক্য থাকুক না কেন হিজাব ব্যবহারের প্রচলন কিন্তু বেড়ে চলেছে। ইস্ট লন্ডনের একটি বিরাট অংশ জুড়ে অবস্থিত মরিয়ম সেন্টার, যেখানে শুধুমাত্র ধর্মপ্রাণ নারীরা গিয়ে থাকেন।
মহিলারা হিজাব ব্যবহার করেন তিনটি কারণে। তার মধ্যে প্রধান কারণটি ধর্মীয়। শরীয়ত মেনে চলা মহিলারা হিজাব ব্যবহার করেন। দ্বিতীয়ত উগ্রপন্থী মহিলারা প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে চলতে এবং পাবলিক প্লেসে নিজেদের সহজে লুকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে হিজাবের আশ্রয় নেয়। তারা তাদের অনৈতিক কাজগুলো বোরকা বা হিজাবের আড়ালে খুব সহজে সম্পন্ন করতে পারে। আরেকটি শ্রেণীর কাছে হিজাব বেশ জনপ্রিয়, তারা হচ্ছেন অল্প বয়সী নারী। মুখের আকৃতি সুন্দর দেখানোর জন্য তারা হিজাবের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ‘অশালীন’ পোশাক লুকিয়ে রাখার জন্য তারা বোরকার আশ্রয় নিয়ে থাকে।
উল্লেখ্য , হিজাব পরা বেশকিছু মডেল ইতিমধ্যে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। পূর্ব লন্ডনে বসবাসরত ২০ বছরের শাহীরা ব্রিটেনের হিজাব পরা প্রথম ক্যাটওয়াক মডেল। ৭ সন্তানের মা তাহিরা বিবিসির সাথে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ২০ বছর বয়স থেকে তাহিরা বোরকা পড়ে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়। বরিস জনসনের মন্তব্য সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, জ্ঞানের অভাব থাকায় বরিস এই ধরনের মন্তব্য করেছেন।
কার্ডিফের সাহার আল ফাফি বিবিসি’র সাথে সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, হিজাব ও নিকাব-এর কারণে আমাকে আশপাশের অনেক মানুষ দ্বারা মৌখিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। উদাহরণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেন, একদিন তাকে কুৎসিত সন্ত্রাসী বলে মন্তব্য করেছিলো একজন। আরেকদিন হসপিটালে এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে যাওয়ার সময় কেউ একজন খুব কাছাকাছি এসে বলেছিলো , আমার মাথা কেটে ফেলো না। তুমি তো আইএস। এই রকম পরিস্থিতি সত্যিই খুব যন্ত্রণাদায়ক।
হিজাব, নেকাব, বোরকা এই আচ্ছাদনগুলো শরীয়ত অনুযায়ী একজন মহিলার শরীর, মাথা এবং মুখ ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় এর অনুভূতি জাগ্রত হয় নিজের ভিতর থেকে। এর জন্য অনুরোধ করতে পারে পরিবারের পক্ষ থেকে কিন্তু শারীরিক নির্যাতন করা শোভনীয় নয়। একজন মুসলিম মহিলা আরেকজন মুসলিম মহিলার সামনে হিজাব করার কোন প্রয়োজন নেই, তবে অমুসলিম নারীদের সামনে হিজাব পরা নিয়ে বেশ বির্তক রয়েছে।
২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল বলেছিলেন, পুরো মুখ ঢেকে পর্দা করার যে রীতি তা তুলে দিতে হবে এবং এই রকম আইন প্রয়োগ সম্ভব। জার্মানির কমপক্ষে ১৬টি রাজ্যে শিক্ষক এবং সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য হেডকাভার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। বাভারিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যের স্কুল, ভোট কেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারী অফিসগুলোতে ২০১৭ সালে পুরো মুখ ঢাকার পর্দা নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৭ সালে অষ্ট্রিয়াতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালতসহ বিভিন্ন পাবলিক স্পেসে বোরকা, হিজাব ও নেকাব নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো।
ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম ফ্রান্সে সর্বজনীনভাবে ইসলামী পর্দা নিষিদ্ধ করা হয়। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজী যার প্রশাসনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, পর্দা নারীদের উপর নির্যাতনস্বরূপ। ফ্রান্স এটিকে কখনো আমন্ত্রণ জানায় না। ২০১১ সালের এক জরিপের তথ্যানুযায়ী, ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলসের ৪.৮% মুসলিম রয়েছে তার মধ্যে ১% মহিলা নিকাব ব্যবহার করে বলে ধারণা করা যায়।
২০০৯ সালে ডেনমার্কে নারীদের পর্দার বিরুদ্ধে জরিমানা ঘোষণা করা হয়। ২০১৪ সালে টেলিগ্রাফে রিপোর্ট হয়েছিলো যে, ১৭টি এনএইচএস হসপিটালে ফ্রন্ট লাইনের স্টাফদের জন্য নিকাবের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিলো। এ ছাড়াও অনেক স্কুল কলেজে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। বেশী বিপাকে পড়তে হয় সীমান্ত এলাকাগুলোতে, নারী চেকারের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় দীর্ঘ সময় ধরে। এক্ষেত্রে ফ্লাইট বিলম্বিত হতে দেখা যায় অনেক সময়। ছদ্মবেশী সন্ত্রাসীদের কারণে বিপাকে পড়তে হয় সত্যিকারের পর্দানশীন মুসলিম নারীদের। আর এই সন্ত্রাসবাদীরা বিশ্বের বুকে বিতর্কিত করে তুলেছে হিজাব, পর্দা তথা পুরো ইসলাম ধর্মকে। এই সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে ইসলাম ধর্মকে। লেখক : লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক।
email : hasinaalam23@yahoo.com