কাকন রেজা : গণমাধ্যমের কথার রেশ ধরে আলোচনা হচ্ছিলো, ক্ষমতার পালাবদল হলে সুশাসন নিশ্চিত হবে কিনা, তা নিয়ে। বসে চা খাচ্ছিলাম আর শুনছিলাম। একজন বললেন, ‘লাভ কী যে লাউ, সেই কদু’। ‘যে লঙ্কায় যায়, সেই রাবণ হয়’। রদবদলে লাভ নেই, এখন যেমন আছে, অন্যরা গেলে তাই থাকবে।
বিপরীতে অন্যজন যুক্তি দিলেন, যে লাউ সেই কদু হলেও তো আমাদের লোকসান নেই। এখন যদি সুশাসন না থাকে, পালাবদলেও সুশাসন পাবো না। তবে পালাবদলে আশা থাকে, সম্ভাবনা থাকে। সেটাই লাভ। যদি বাইচান্স হয়ে যায়, পেয়েই যাই অধরা সুশাসন, তাহলে তো পুরোটাই লাভ। আর না হলে ক্ষতি নেই, যেই কদু সেই লাউ। সুতরাং আশা নিয়েই বাঁচি না।
মানুষ যতো ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে যায়, মানুষের চিন্তা ততোটাই পরিষ্কার হয়, ধারণা সমৃদ্ধ হয়। তাই চায়ের দোকানের যুক্ততর্ককে এখন আর চায়ের কাপের রাজনীতি বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বরং অনেক টিভি ‘টকশো’কেও বালখিল্য মনে হয় সেই আলোচনার সামনে। অবশ্য এর কারণও রয়েছে। ‘টকশো’গুলোতে সব কথা বলতে মানা, সেখানে নানা ধরণের ‘অনুভূতি’র প্রশ্ন রয়েছে। চায়ের টেবিলে সেসব নেই। ‘মানা না মানা’র বাধ্যবাধকতা না থাকায় সেখানে উঠে আসে মানুষের প্রাণের কথা, যুক্তিতর্কে থাকে নির্জলা সত্যের নির্যাস। সেই যুক্তিকে কেটে বেরিয়ে আসা এখন ঝানু বুদ্ধিজীবীদের পক্ষেও কঠিন। ক্রাইসিসের মধ্যে যাওয়া মানুষের চিন্তা-ভাবনা হয় কষ্টি পাথরে যাচাই করা। তাদের উপলব্ধি বাস্তবতার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর বা স্টুডিওর নয়। এমন মানুষকে বোকা বানানো এখন আর সহজ নয় এবং সেই দিনও প্রায় শেষ। তাদের হয়তো কিছুটা সময় দমিয়ে রাখা সম্ভব, কিন্তু সবসময় কি সম্ভব?
এক সময় বোকা মানুষেরা আবেগতাড়িত হয়ে ভোট দিতেন। রাজনীতিবিদদের বক্তব্যও ছিলো চমৎকার। তারা আদর্শের কথা, স্বপ্নের কথা বলতেন, মানুষ বিশ্বাস করতো। ক্রমে মানুষের সে বিশ্বাস ভাঙলো। তারপর শুরু হলো এক প্যাকেট বিড়ি, একশ টাকার ব্যবহার। ভোটের পুঁজি। এরও পর টাকার সংখ্যা বাড়তে থাকলো, রাজনীতিবিদরা ক্রমেই হাঁপিয়ে উঠলেন, জায়গা করে নিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তখনো ভোট ছিলো। কারণ, কথা না হলেও টাকা দিয়ে মানুষকে বোকা বানানো যেতো, টাকা দিয়ে ভোট কেনা যেতো। ভোট পণ্য হলেও টিকে ছিলো। অন্তত ভোটের জন্য ভোটারের প্রয়োজনটা ছিলো।
ক্রমে মানুষ বুঝতে শিখলো, কথায় বা টাকায় ভোট বিকোলে, তাদের মাথা বিকায় ভোটের ক্রেতারা। ফি বছর তাদের মাথায় বাড়ে ঋণের বোঝা। তারা বিগড়ে যেতে শুরু করলো। প্রমাদ গুণলেন ভোট বেপারিরা। ধারাবাহিকতায় এলো, ভোট নয়, ভোটারবিহীন নির্বাচনের ধারণা। তারপর তো ইতিহাস এবং তা সবারই জানা।
দুই. ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘হাউস অব কমন্স’ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বলেছে, ‘বাংলাদেশে নির্বাচনের ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নেই’। এটা বলার পর দেখলাম কারো কারো খুব উৎসাহ, তারা বলতে লাগলেন, দেখেছো ব্রিটিশরা বলেছে, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নেই। অবস্থা অনেকটা কনে দেখতে যাওয়া ‘কনফিউজড’ পাত্রের মতন। যে পাশে বসা মামাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মামা মেয়েটা কি দেখতে সুন্দরী না, একে বিয়ে করা যাবে?’ যাদের নিজের চোখের উপর ভরসা নেই, তাদের তো ‘মামা’ লাগবেই।
একজন মানুষের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা এবং সাহস হলো ‘না’ শব্দটা উচ্চারণ করা। আরে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তো নেই, সেটা বলতে হবে কেনো। যেটা নেই তো নেই। অন্যের কথা শোনার আগে নিজের ‘কনফিউজড’ হবার মানসিকতা দূর করতে হবে। তারপর সুমনের গানের মতো বলতে হবে, ‘কন্ঠ ছাড়ো জোরে’। তাতেই যদি কিছু হয়।
‘কিছু হয়’, এই ‘হওয়া’র দায়িত্বটাও যারা ভোটের বেপারি তাদেরই। যে রাজনীতিবিদরা নির্বাচনকে একটি ‘যুদ্ধ’ বানিয়ে ছেড়েছেন তাদের প্রয়োজনেই একে আবার ‘উৎসবে’ পরিণত করতে হবে। নয়তো এখন সর্বসাধারণ পস্তাচ্ছে, আখেরে পস্তাতে হবে তাদেরই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
আপনার মতামত লিখুন :