অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার : নির্বাচনের আগে সংলাপের কোনো প্রয়োজন নাই এ ব্যাপারে সরকার অত্যন্ত আপোস বিমুখ থাকলেও সম্প্রতি বিএনপিসহ সকল দলের সাথেই সংলাপ করছে এবং ক্ষুদ্র পরিসরেও সংলাপ হচ্ছে। স্বাধীনতার আগে থেকেই এ দেশের সংলাপের ইতিহাস অনেক রূঢ়, অনেক কন্টকময়। ব্যর্থ হয়েছিলো মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক বা সংলাপ, স্বাধীনতার পর যে কয়টি সংলাপ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হয়েছে তাও সফলকাম হয়নি। জাতি মাঝেমধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বটে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন ছাড়া তার স্থায়িত্ব ঘটেনি। যেমনটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সাংবিধানিক সংশোধনকে আরও একটি সংশোধনে বাতিল করে সরকার বলছে যে, সংবিধান থেকে একচুলও তারা এখন আর নড়বেন না। এ নড়ানো বা না নড়ানো থেকেই জাতি দ্বিধাবিভক্তি থেকে নড়ানোর পক্ষেই বেশি ধাবিত হচ্ছে। এক সময় সরকার বলতো, পাকিস্তানপন্থী আগুন সন্ত্রাসী বিএনপি-জামায়াত নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়, কিন্তু এখন দেখা যায় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে যারা বীর ছিলো তারাও ৬ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সভাপতিত্বে জনসভা করেছে যার প্রধান দাবি ছিলো বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ রাজবন্দীদের মুক্তি, শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন।
এখানে জোর গলায় দাবি তুলেছেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ড. কামাল হোসেন, প্রধান বক্তা আ স ম আব্দুর রব যারা একসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ ও দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। যদিও আওয়ামী ঘরনার বিচারপতি সামশুদ্দিন চৌধুরী মানিক ড. কামালকে রাজাকার বলেছেন। অন্যদিকে সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় বহুবার কাদের সিদ্দিকীকে ইতোপূর্বেই রাজাকার বলে সম্বোধন করা হয়েছে, যা তিনি নিজের মুখেই প্রকাশ করেছেন। যারা শেখ মুজিবকে অশালীন ভাষায় সম্বোধন করে ছিল তারাই এখন শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রিসভায়। এখন মেরুকরণ যা হচ্ছে তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকারের ‘চেতনা’ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে যখন স্বাধীনতার যোদ্ধারা ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি মঞ্চে অবস্থান নিয়েছে? ফলে বিষয়টি সহজেই অনুমেয় যে, ‘স্বাধীনতার চেতনার’ একমাত্র সোল এজেন্ট আওয়ামী ঘরনার বুদ্ধিজীবী ও সরকার কতটুকু বাজারজাত করতে সক্ষম হবেন? ফলে এটাই সাবস্ত করা যায় যে, শেখ হাসিনা সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী যারা তাদের পক্ষে থাকবে তারাই স্বাধীনতার চেতনাধারী বাকিরা সব রাজাকার!
পূর্বেই বলেছি যে, এ দেশের সংলাপ সফল হওয়ার ইতিহাস খুবই মলিন। কারণ যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের ক্ষমতাকে ধরে রাখার কামনা বাসনা অনেক তীব্র থেকে তীব্রতর। সে কারণেই সংলাপ সফল না হলেও কিছু কথা বেরিয়ে আসে যা থেকে ক্ষমতাসীনরা দেশবাসীকে কতটুকু ওজনে মাপে বা কতটুকু জ্ঞানী বা বোকা মনে করে তা অনুমান করা যায়। প্রথম দিন সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের নিকট যে, ব্রিফিং করেছেন তাতে বোঝা যায় যে, সফল রাজনৈতিক মামলার একটি তালিকা তার নিকট (ওবায়দুল কাদের) জমা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ করেছেন, যদি তাই হয় তবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দেশব্যাপী মৃত ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থানরত, অসুস্থ, পঙ্গুসহ শত শত মানুষের বিরুদ্ধে যে গায়েবি মামলা হচ্ছে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এখানে উল্লেখ যে, রাজনীতি কোনো সংবিধানিক বা ফৌজদারি অপরাধ নয়, ফলে রাজনীতি করার অপরাধে কোন আইন আমাদের দেশে নাই। তবে সরকার প্রতিপক্ষকে দমানোর উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য যে, মামলা করে সেটাই রাজনৈতিক মামলা। প্রতি থানায় প্রতি মাসে সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে ২৫-৩০-৪০টি গায়েবি মামলা হচ্ছে যার সাথে সত্যতার কোনো লেশমাত্র নাই। একদিকে সরকার বলছে রাজনৈতিক মামলার তালিকা দেন, অন্যদিকে প্রতি দিনই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে, বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ আগাম জামিন নিতে এসে হয়রানি হচ্ছে তা সরকার জানে না, এ দ্বিমুখী কথা বর্তায় কী বোঝা যায় যে, সরকার সত্যিই কী কোনো সমাধান প্রত্যাশা করেন?
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবি