অলিউল্লাহ নোমান : সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান মামলায় দেখলাম সৈয়দ জগলুল পাশার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। তিনি এই মামলার একজন সাক্ষী। প্রশ্ন হচ্ছে সৈয়দ জগলুল পাশা তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চাকুরি করেছেন কার সুপারিশে! তাঁর দুই ভাই লন্ডনে কট্রর আওয়ামী লীগার। তাইলে কি তিনি আওয়ামী লীগের চর হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তখন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন?
১৯৯১ সালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকা কালীন সময়ে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর মহাপরিচালক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন মেজর জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মম নাসিম। তাঁকে পরবর্তীতে সেনা প্রধান বানানো হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ২০ মে সেনা অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তিতে প্রমাণিত হয়েছে তিনি ছিলেন চরম আওয়ামী পন্থি।জীবনবাজি রেখে সেই অভ্যুত্থান প্রতিহত করতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন ডিজিএফআই মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এম এ মতিন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার সুবিদ আলী ভুইয়া, রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সামরিক সচিব মেজর জেনারেল রুহুল আলম চৌধুরী। তখন থেকে মেজর জেনারেল এম এ মতিনকে দেখে আসছি। সুবিদ আলী ভুইয়াকেও দেখেছি তখন থেকেই। তারা কট্রর দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তবাদী আদর্শে উজ্জীবীত ছিলেন বলেই মনে হত।
বিশেষ করে চাকুরি থেকে অবসরের পর এই দুই জেনারেল দৈনিক ইনকিলাবে নিয়মিত লিখতেন। তাদের লেখায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে এবং জাতীয়তাবাদে উজ্জীবীত করত আমাদের। আমি নিজেও তখন ইনকিলাবের একজন সংবাদ কর্মী ছিলাম।
কিন্তু ১/১১-এর জরুরী আইনের সময় উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নিলেন মেজর জেনারেল এম এ মতিন। তাঁর কিছু ক্ষোভ ছিল জানতাম। কেন সেই ক্ষোভ ছিল সেটাও জানতাম। সামান্য একটু উদ্যোগ নিলেই কিন্তু সেই ক্ষোভ মেটানো যেত। কিন্তু তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে আর অবহেলার কারণে ক্ষোভ রয়ে গেল। তিনি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন কড়ায় গন্ডায়।
সুবিদ আলী ভুইয়ারও একই অবস্থা। অনেকটা অবহেলা সইতে না পেরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ থেকে দুইবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। যার কারণে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন তাঁকে পরাজিত করেই কিন্তু বিজয়ী হয়েছেন তিনি।
মেজর জেনারেল মঈন ইউ আহমদ। ৯ জনকে ডিঙ্গিয়ে সেনা প্রধান বানানো হয় যাকে। তাঁর চামচামির একটা বর্ণনা করেছিলেন একজন সামরিক অফিসার। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতা থেকে যাওয়ার দুই দিন আগের ঘটনা। ঈদুল আজহা ছিল সেদিন। ৩ বাহিনী প্রধান প্রথা অনুযায়ী ঈদের দিন বিকালে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে যান প্রধানমন্ত্রীর ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে। ৩ জন একই ব্র্যান্ড ও একই রঙ্গের পায়জামা পাঞ্জাবি পরিধান করে গিয়েছিলেন সেদিন। একই জায়গা থেকে তাদের এই পোশাক উপহার দেওয়া হয়েছিল। তাই কাকতালীয় ভাবে ৩ জনের পোশাক ছিল হুবহু একই রকম সেদিন।
ঈদের শুভেচ্ছা শেষে প্রধানমন্ত্রী স্বভাবসূলভ ভাষায় বললেন, অনেক কিছুই করার ছিল ৩ বাহিনীর জন্য। অনেক কিছু প্রক্রিয়াধীন রেখে যাচ্ছি। আল্লাহ যদি সুযোগ দেন ভোটে বিজয়ী হয়ে আসতে পারি বাকী কাজ গুলো করে দেব ইনশাল্লাহ। আপনারা দোয়া করবেন। বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনী প্রধান সৌজন্যতা দেখিয়ে বললেন, অবশ্য আমরা দোয়া করি। কিন্তু, সেনা বাহিনী প্রধান মঈন ইউ আহমদ ছিলেন একটু ব্যতিক্রম। দুই হাত কসলাতে কসলাতে বলতে থাকলেন- সারা দেশ থেকে আমার গোয়েন্দা সোর্সে পাওয়া খবর হইল আপনি-ই বিজয়ী হবেন ম্যাডাম।
আপনিই বিজয়ী হবেন। এরকম কয়েকবার বলতে থাকলেন এবং দুইহাত কসলাতে থাকলেন। তাঁর এই চামচামি দেখে বাকী দুই বাহিনীর প্রধান মুসকি হাসতেছিলেন। (সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত একজনের বর্ণণা এটি)
সেনা প্রধানের এই চামচামির ২ দিন পরই ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয় চার দলীয় জোটের। চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতা ত্যাগের আড়াই মাসের মাথায় নিজেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিলেন মঈন ইউ। শুধু তাই নয়, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবারকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল তাঁর।
সেটা করতে ব্যর্থ হয়ে শহীদ জিয়াউর রহমানের দুই ছেলেক অসুস্থ বানিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করলেন।রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সামরিক সচিব পদটিও গুরুত্বপূর্ণ। তখন এই গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ পেয়েছিলেন মেজর জেনারেল আমিনুল করিম। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ জামালের কোর্সমেট। তাই শেখ পরিবারের প্রতি তাঁর ছিল শতভাগ অনুরাগ । ১/১১-এর জরুরী আইন জারিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা ছিল তাঁর।
১৯৯১ সালে বিএনপি ভোটে বিজয়ী সরকার গঠন করে বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে সচিব হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় ড. কামাল সিদ্দিকীকে।
প্রথম ক্ষমতার প্রায় পুরো সময় জুড়ে ড.কামাল সিদ্দিকী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব। ২০০১ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে বানানো হল মূখ্য সচিব। একই সাথে তিনি কিছুদিন কেবিনেট সচিবের দায়িত্বও পালন করেন। অর্থাৎ দুই দফায় প্রায় ১০ বছর তিনি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে কাজ করেছেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে। কিন্তু তিনি এখন সমানে বিরোধীতা করেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ