অজয় দাশগুপ্ত, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে : ভারত গাঁধির দেশ। মহাত্মা গাঁধী যিনি উপমহাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য হিন্দু মুসলমানের মিলনের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। বিস্ময়ের সাথে দেখি যখন প্রযুক্তি ও আধুনিকতা নামে আজকের বিশ্বায়ন ছিলোনা তখন মানুষ কত উদার ছিলেন। বলিনা যে তখন সাম্প্রদায়িকতা ছিলনা। বরং তখন এই উপমহাদেশে বড় বড় দাঙ্গায় হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ জান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সবাই মানেন সেই দাঙ্গা ও উস্কানির পেছনে ছিল দেশভাগের দেশি বিদেশি নায়কেরা। রাজনীতিতে তখন চরম উত্তেজনা। সেকুল্যার নেহেরু যেমন সেটা ঠেকাতে চাননি বা পারেননি তেমনি আচরণগত ভাবে অধার্মিক, পানাহারে মত্ত জিন্নাহ চেয়েছিলেন যেন তেন প্রকারে দেশভাগ। কিন্তু সেতো আজ সত্তর বছরের গল্প। আজো যখন আমরা চোখ রাখি ভারত পাকিস্তান এমনকি দুবার স্বাধীন হ ওয়া আমাদের দেশে সে একই বাস্তবতা সে এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা দেখতে পাই।
ভারতকে বাইরের দেশগুলো নানা কারণে অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে চেনে। মানতে হবে তাদের দেশ গণতন্ত্র অনেক আগেই প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করেছে। সে দেশের সংবিধান ও উদারতাকে লালন করে। প্রতিবেশি পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসী ছাড়া কেউ সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপতি হতে পারেনা। এমনকি সরকার প্রধানের চাপরাশী হলেও সন্দেহ বিরাজমান সেখানে এই সেদিন ও আবদুল কালাম ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। সেখানে আমাদের দেশের মতো একতরফা মারি হয়না। হয় মারামারি। বলাবাহুল্য হিন্দুরা যেহেতু সংখ্যায় বেশি নানা জায়গায় তারাই মারে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু নামে পরিচিতদের পিঠ সর্বদাই দেয়ালে।
তারপর ও এটা মানা যায়না সেদেশে কেবল গরুর খাতিরে মুসলমানদের মারা হবে। ইদানীং প্রায় ই দেখি গরুর গোশত খাবার অপরাধে রাখার অপরাধে বহনের অপরাধে খুন করা হচ্ছে। এই ঘৃণ্য মানসিকতা কিংবা সাম্প্রদায়িকতা ভারতের অতীত বা ঐতিহ্যের সাথে বেমানান। মানুষ ধার্মিক হতেই পারে। অর্মত্য সেন একটি চমৎকার কথা বলেছিলেন। তার বিশ্লেষণে আচরণগত ভাবে ধার্মিক হবার পর মহাত্মা গাঁধি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জনক। অন্যদিকে আচরণগত ভাবে অধার্মিক শুয়োরের মাংস মদ পানে অভ্যস্ত জিন্নাহ ছিলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুরোধা। ফলে আমরা একথা বলতে পারিনা ধার্মিক মানেই সাম্প্রদায়িক। সে কারণে আমার মতো কোটি কোটি মানুষের মনে ঢোকেনা কোথা থেকে এই উৎপাত বা আক্রমনের ইন্ধন আসছে। ভারতে অসংখ্য গুণী অগুণিত ভালো মানুষ আর প্রগতিবাদীর বসবাস। সেদেশে কিভাবে গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে এই সাম্প্রদায়িকতা? বহুভাবে এগিয়ে থাকা ভারত এইদিকে বাংলাদেশের চাইতে অনেক পিছিয়ে। আমাদের দেশে নিত্য সংগ্রাম নিত্য সাম্প্রদায়িকতা মূর্তিভাঙ্গার পর ও মাংস গোশত নিয়ে মানুষ হত্যার ইতিহাস নাই। আমি নিজে হিন্দু পরিবারে জন্ম নেওয়া মানুষ। ছেলেবেলায় বাবাকে দেখতাম বিরাট বিরাট কাছিম এনে রাখতেন পানির ড্রামে। রোববারে এদের রোদে ফেলে গলা বেরিয়ে এলে কাটার ধুম পড়ত। আমরা থাকতাম শহরে। সেখানে নাছিল পুকুর না জলাধার। সেই কাছিমগুলো কেনা হতো বাজার থেকে। প্রকাশ্যে বিক্রি হওয়া কাছিমের দেশের মানুষ আমি। চট্টগ্রাম শহরের অনেক বাজারে শুয়োরের মাংস ও সহজলভ্য। শহর ছাড়িয়ে পার্বত্যজনপদের দিকে পা বাড়ালেই সহজলভ্য এই মাংস। এযাবৎ কোনোদিন সে কারণে কাউকে খুন করা বা মেরে ফেলার কথা শুনিনি।
মানুষের জানের চাইতে মাংস বা গোশত বড় এই কি গণতন্ত্র? ভারতে যা হয় বা যা ঘটে তার প্রভাব পড়ে উপমহাদেশে। পাকিস্তানের কথা বাদ। বাংলাদেশে এখন যে কোনো বিষয়ে প্রচার আর গুজবের বড় হাতিয়ার সামাজিক মাধ্যমগুলো। আন এডিটেড এই মিডিয়ার বড় কুফল যার যা খুশি তা লিখতে পারে। লিখে দিলে কি হয় বা কি হতে পারে তার বহু প্রমাণ দেখেছি আমরা। ভারতে যারা বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য কান্নাকাটি করেন তাদের মগজে কেন এটা ঢোকেনা এইসব ঘটনায় আরও বেশি বিপদে পড়ে তারা। তাছাড়া যারা বড় বা যাদের শক্তি ও দাপট বেশি তাদের কাছে পরিমিত ও শীলিত আচরণ কাম্য মানবতার। সেজায়গাটা যতদিন এমন থাকবে ততদিন দুনিয়ায় মারামারি হানাহানি ও কমবেনা। ভারতের পুরনো ঐতিহ্য এমনকি ধর্ম বিশ্বাসেও গো মাংস খাওয়ার কথা আছে। সে দিকটা ভুলে যারা এই তুচ্ছ বিষয়ে মানুষের জান কেড়ে নেয় তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কি থাকতে পারে?
সভ্যতা এগিয়েছে মানুষ এগিয়েছে বলে গর্ব করা এই বিশ্বে আমরা আজ সত্যি অসহায়। ভারতেতো বটেই দেশে দেশে মানুষের ধর্মবিশ্বাস নেমে এসেছে হেঁসেলে। পোশাকে। আগে মানুষের ধার্মিকতা ছিল অন্তর ও আচরণের শুদ্ধতায়। এখন আর তা নেই। এখন কার মাথায় কাপড় কার মাথা উদোম কার পোশাক কত স্বল্প কার বেশি কার পেটে গরু কার পেটে খাসী এই হচ্ছে ধার্মিক হবার যোগ্যতা। সে বাস্তবতায় ভারতে গরুর মাংস বিষয়ক বাড়াবাড়ি এবং মুসলমান হত্যা আসলেই গণতন্ত্রের দেউলিয়াত্ব। এই দেউলিয়া গণতন্ত্র কিভাবে শক্তি যোগাবে আমাদের? এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে কেউ মরলেও কারো কিছু আসে যায়না। মুসলমান মরলে হিন্দুর আনন্দ হিন্দু মরলে মুসলিমের খুশির দুনিয়ায় মানুষ কোথায়?
সভ্যতা অসভ্যতা মানবিকতা অমানবিকতা সবতো আসলে মানুষের জন্য। মানুষ ধর্ম আচরণ করে ধর্ম পালন করে বলেই ধর্ম মহান। সেই মানুষ হিন্দু না মুসলমান সে প্রশ্ন কি আসলেই যৌক্তিক? না ভয়াবহ? আসলে এভাবে দুনিয়ার সহনশীলতা ও সহ্য কমতে থাকলে একদিন গরু ছাগল ভেড়া থাকবে মানুষ থাকবেনা। এটাই কি উন্নতি বা পরাশক্তি র চেহারা? জানি উত্তর মিলবেনা। তবু আশা করবো শুভবুদ্ধি ফিরবে ভারতের। শুভ বুদ্ধি উদিত হবে আমাদের দেশে ও । মানুষকে তার নিজের মতে নিজের বিশ্বাসে নিজের নিয়মে চলতে দেওয়া এবং তা সয়ে পাশাপাশি থাকার নাম পৃথিবী। সে পৃথিবী সে সভ্যতা শুধু খাবার বা অন্ধত্বের জন্য শেষ হয়ে যাবে?
লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক