শিশির ভট্টাচার্য্য, ফেসবুক থেকে, ‘জাতিরাষ্ট্র’ নামক কুসংস্কারটির জন্ম ২৪শে অক্টোবর ১৬৪৮ সালে, যেদিন ইউরোপে ওয়েস্টফিলিয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। রাষ্ট্র একটি ধর্ম এবং ধর্মের মতো রাষ্ট্রও একটি কুসংস্কার। রাষ্ট্র্ এবং ধর্ম উভয়েই অতীতে এবং বর্তমানে বহু গণহত্যার কারণ হয়েছে, মানুষের অগ্রগতিতে বাধা দিয়েছে। রাষ্ট যে মানুষের অগ্রগতিতে বাধা দেয়, সেটা পাসপোর্ট ছাড়া ভারতের দিকে গতিপ্রাপ্ত হলেই বুঝবেন। রাষ্ট্র যখন ছিল না, তখন কত সহজে আপনি কোলকাতা-দিল্লি চলে যেতেন। উঠলো বাইতো দিল্লি যাই।
ধর্মের মতো রাষ্ট্রেরও গ্রন্থ আছে : সংবিধান; একাধিক মূর্তি আছে: (লাল-সবুজ) পতাকা, প্রতীক (শাপলা), (কেষ্টঠাকুরের মতো ত্রিভঙ্গ) মানচিত্র; প্রার্থনামন্ত্র আছে: জাতীয় সঙ্গীত। জাতিরাষ্ট্রের ধারণাটা একটা সার্বজনীন বিশ্বাস — ধর্ম, ভাষা এবং মুদ্রার মতো। এমনকি নিজের দেশের জন্য শহীদ হওয়াটাও একটা বিশ্বাস বা সংস্কার, যার বয়স এখনও ৫০০ বছরও হয়নি।
যারা ভাষা ও মুদ্রা ব্যবহার করে, কিংবা ধর্ম পালন করার ভাব ধরে, তারা বিনাপ্রশ্নে এই তিন সংশ্রয় বা সিস্টেমকে মেনে নেয়। যারাই বিনা প্রশ্নে কোনো কিছু মেনে নেয়, তারা কমবেশি মূর্খ। কেউ যদি নিজেকে বিশ্বাসী মনে করে, তবে ধরে নিতে হবে, প্রশ্ন করার ঝামেলায় তিনি যেতে চান না। যিনি প্রশ্ন করতে চান না, তিনি যে মূর্খ থেকে যাবেন, তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।
কিছুটা মূর্খ না হলে যেমন ভাষা ব্যবহার করা যায় না, মুদ্রা ব্যবহার করা যায় না এবং ধর্ম পালন করা যায় না, তেমনি জাতিয়তাবাদীও হওয়া যায় না। এক ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মের লোক যেমন সাধারণত অন্য ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের লোকের প্রতি কমবেশি বিরাগ অনুভব করে, এক দেশের টাকা ও মুদ্রা যেমন অন্য দেশে চলে না, তেমনি এক দেশের লোকও অন্য দেশের লোককে সহজেই ঘৃণা করে। ঘৃণার অনুভূতিটা মানব মস্তিষ্কে সহজাত, ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ এই সহজাত অনুভূতিটা উশকে দেয় মাত্র।
আমি খেলাটেলা কখনই দেখি না। এই খেলাও এক ধরণের সংস্কার বটে। দুই দল লোক কিছু নিয়ম টিয়ম মেনে মাঠে একটা বল নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে, কিংবা চেলা কাঠ দিয়ে একটা বলে বাড়ি মারছে — এই সব নিজে করলে কিছুটা শরীরচর্চা হয় বটে। কিন্তু ভূঁড়ি বাগিয়ে সোফায় বসে অন্যের শরীরচর্চার চলচ্চিত্র দেখা, কিংবা যে ধর্ম কিংবা জাতি কিংবা রাষ্ট্রকে যে কারণেই হোক, মন থেকে ঘৃণা করি, সেই রাষ্ট্রের পরাজয়ে উল্লাসে অষ্টখণ্ড হওয়া — না এতটা শিশুতোষ আমি হতে পারি না। এটা হয়তো আমারই একটা ব্যর্থতা। আমি হয়তো ‘হংসমধ্যে বকো যথা’।
ভারতের পেঁয়াজ, আলু, মাছ, ডিম সব গিলবেন, পাকিস্তানী হানাদারেরা আপনাকে, নিজের মা-বোনকে হত্যা-ধর্ষণ করছে — এই অজুহাতে সটান ভারতে গিয়ে (কেন আরেক প্রতিবেশি বার্মা ছিল না?) হাজির হবেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেবেন, আপনার দেশের জন্য মাত্র ৯ দিনের যুদ্ধে কমবেশি ৯,০০০ ভারতীয় সৈন্য নিহত হবে, ভারতের ভিসার জন্য এত বেশি আবেদন করবেন যে তিন/চার মাসেও ভিসা পাওয়া যাবে না, কিন্তু অন্তরে সেই ভারতকে আবার প্রাণপণে ঘৃণা করবেন, চুপকে চুপকে ভালোবাসবেন জিগরি পাকিস্তানকে — এটাকে কি যুক্তিসঙ্গত কোনো আচরণ বলা যায়?
যুক্তিসঙ্গত হবার কোনো কারণও নেই, কারণ ভাষা, মুদ্রা, ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতিয়তাবাদ এসব যুক্তি মেনে চলে না। এগুলোতে যারা বিশ্বাস রাখে, তারা, আগেই বলেছি, কমবেশি মূর্খ। মূর্খদের কারণেই এই সব সিস্টেম চলে।
ধর্ম, ভাষা, মুদ্রা, সংস্কৃতির মতো কেন জাতীয়তাবাদকেও হাস্যকর কু-সংস্কার বলতে চাই? যা কিছু মানুষের ক্ষতি করে আগে পরে, মানবজাতির অগ্রগতি রুদ্ধ করে, যেমন ধরুন, এক জাতীয়তাবাদের কারণে কী পরিমাণ গণহত্যা হয়েছে ১৯৪৭ কিংবা ১৯৭১ সালে, এই ভারতবর্ষে, এটাকে কি কোনো বিচারে যুক্তিসঙ্গত বলা যায়?
যা কিছু যুক্তিসঙ্গত নয়, তা কেন কুসংস্কার হবে না?
তবে এটাও ঠিক যে মানুষের জীবনটাই একটা কুসংস্কার, কারণ মৃত্যুতে মানুষের এই হাস্যকর অস্তিত্বের অবসান হয়। সুইস ব্যাংকে যত টাকাই আপনি জমান, যত বেশি বইই আপনি লেখেন, যত প্রার্থনাই আপনি করেন, যত জমিই আপনার থাক, আজিমপুরের গাছগুলো ‘হা করে’ (গাছেরও হা আছে?) অপেক্ষা করে আছে, কবে অ-সার জীবন সাঙ্গ করে অপরিণত আপনি তাদের সারে পরিণত হবেন।
আপনার মতামত লিখুন :