শিরোনাম

প্রকাশিত : ০৮ জুন, ২০২৩, ০৪:১৮ দুপুর
আপডেট : ০৮ জুন, ২০২৩, ০৪:১৮ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আত্মপ্রবঞ্চক না কি অবিমৃষ্যকারী?

আর রাজী

আর রাজী, ফেসবুক থেকে: আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে মফস্বলে। একটা গাঙের খুব কাছে ছিল আমাদের বাড়ি। ওই গাঙের সাথেই আমাদের শৈশব-কৈশোরের অনেক স্মৃতি বাঁধা।
সেখানে স্নান করতাম, মাছ ধরতাম, জলেই চলতো নানান খেলা। কিন্তু সেই সব সুখের সাথে মিশে ছিল মনুষ্য বিষ্ঠাও। 

নদীর পাড় ধরে নানান জায়গায় মানুষ মল ত্যাগ করতো। অনেকের বাসার পায়খানা ছিল নদীর পাড়ে। মল সরাসরি নদীতে পড়তো। এই নদীর ঘাটেই দেখতাম মেয়েরা বাচ্চা-বুড়োদের মলমাখা কাপড় ধুতো। মরা গরু-মহিষ-ছাগল ভেসে যেতেও দেখতাম প্রায়শই। ভোরে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নৌকার গোলুইতে বসে প্রকৃতিক কর্ম সারতে দেখেছি জেলে-মাঝিদের। 

এই নদীর জলেই মানুষ স্নানাদি সারতো। হিন্দু নারী-পুরুষকে এই নদীর জলে দাঁড়িয়েই স্নানান্তে সূর্যপ্রণাম করতেও দেখতাম। অনেক নারী এই নদী থেকেই কলসি করে জল তুলে নিয়ে বাসায় ফিরে যেত। অনেককে কয়লা দিয়ে দাঁত মেজে ওই পানিতেই কুলকুচি করতে দেখেছি।

আমাদের বাসার কাছে একটা পুকুর ছিল। সেই পুকুরের ছিল সানবাঁধানো দুটা ঘাট। ওটিতে স্নান করতে গিয়েও দেখতাম মেয়েরা বাসার থালাবাসন যেমন ধুচ্ছে, তেমনি বাসার কাপড়চোপড় ইত্যাদিও ধুচ্ছে। এই পুকুরেও গরু-ছাগল ধোয়াইতেও দেখেছি। এমনও দেখেছি বহুবার, ভাসতে ভাসতে কাছে চলে আসা মনুষ্যবিষ্ঠা পানিতে ঢেউ তুলে দূরে সরিয়ে দিয়ে স্নান সেরে নিচ্ছে মানুষ। জলে নেমে নিজে থুতু ফেলে সেই থুতু জলে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে ঝপ ঝপ ডুব দিয়ে চলেছে।

নদী-পুকুরে নামলে আমার একটা অস্বস্তি হতো। আম্মা খুব অপছন্দ করতো নদীপুকুরে স্নান করা। সেখান থেকে স্নান করে এলেও বাসায় এসে আবার কলের পানিতে গা-ধুয়ে নিতে হতো। আম্মা প্রায়ই নদীর পানি থেকে রোগ বালাইয়ের কথাও বলতেন। তার মানে, অনেকেই ভালভাবে জানতো যে পুকুর-নদীর পানি স্নান-গোসলের জন্য নিরাপদ না। তারপরও শত শত মানুষ ওই রকম নদী-পুকুরের অমন পানিতে স্নান-গোসল করতো। এইটা কীভাবে সম্ভব হতো বা হয়?

নদীর পাড়ে যারা পায়খানা বসাতো, যারা নদীর পাড়ে হাগুমুতু করতো, যারা কাপড়ে মাখা বিষ্ঠা ধুতো তারাই আবার নদীতে স্নান করতো, নদীর জল মুখে নিয়ে কুলকুচি করত, কলসিতে জল ভরে নিত। ওরা কী বুঝতেন না যে এই জলে কিছু একটা ঝামেলা বা অশূচ রয়ে যাচ্ছে? তারা বুঝতেন, কিন্তু বুঝটা ছিল সংকীর্ণ- নিজের সামনের অংশের পানিটুকু পরিষ্কার থাকলেই তারা মনে করতে চাইতেন যে তার পানি পবিত্র। সম্ভবত এ কারণেই হাত দিয়ে জলে ভাসা বিষ্টা দূরে সরিয়ে নিজের কাজটুকু সেরে নিতে তাদের কোনো অসুবিধা হইতো না! এখন কি এই দৃশ্য হারিয়ে গেছে? সম্ভবত যায়নি। তবে একদিকে জলের বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র সম্পর্কে কিছু জানাশোনা হওয়ায় আর অন্যদিকে টিউবওয়েল বা পানি সাপ্লাই ব্যবস্থার প্রসার হওয়ায় মানুষের শূচিতার ধারণায় ও আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে।

এই কথাগুলো এই তাপদগ্ধ সময়ে প্রায়শই স্মরণ হচ্ছে। কারণ- এখনও মানুষ প্রকৃতিকে বিভাজ্য জেনে এই রকমই আত্মপ্রতারণা করে চলেছে। অন্য মানুষ বা প্রাণীকূলের কথা বিবেচনায় না নিয়ে নিজের ঘরের গরম হাওয়া মানুষ যন্ত্র দিয়ে টেনে বাইরে ফেলে দিচ্ছে, নিজের ঘরকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য ঘরের বাইরে রাত-দিন কার্বন হাগু করে চলেছে। আগের দিনের নদী-পুকুর ব্যবহারকারীদের মতোই সে ভাবছে, নিজের ধারেপাশের ময়লাটুকু দূরে ঠেলে দিলেই তার মুক্তি। মানুষ কি আসলে আত্মপ্রবঞ্চক না কি অবিমৃষ্যকারী? না কি দুটোই?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়