শিরোনাম
◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামের জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত : ২৫ মার্চ, ২০২৩, ১২:১৫ রাত
আপডেট : ২৫ মার্চ, ২০২৩, ১২:১৫ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘গণহত্যা দিবস’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করুক

অজয় দাশগুপ্ত

অজয় দাশগুপ্ত, সিডনি থেকে: এখন বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। ৫২ বছর পর একটি দেশের সিনিয়র সিটিজেন বা বয়স্ক মানুষের সংখ্যায় আগের মানুষগুলো থাকবেন নাÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কে থাকে, কে থাকে নাÑ সেটা তো বিবেচ্য হতে পারে না। ইতিহাস থাকে। থেকে যায় সময়ের দাগ। সময় নিজেই কি সব ঠিক করে? না সময়কেও ঠিক করে দিতে হয় তার অভিযাত্রা? এত বছর পর আমার বয়সী মানুষের মনে ২৫ মার্চের যে ছবি আঁকা আছে তা এখনো ভয়াবহ। বললাম যে বদলে গেছে, এই বদলে যাবার কারণ যাই হোক ২৫ মার্চ কিন্তু বদলাবে না। কারণ তার হাতে রক্তের দাগ। 

আসুন ইতিহাসের দিকে তাকাই : ‘আর্চার ব্লাডের লেখা দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হওয়ার সময় মেশিনগানের গুলি চালিয়ে তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল। ২৬ মার্চ সকালের দিকে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুম এবং ৮৮ ইউনিটের মধ্যে যে কথোপকথন হয় তার রেকর্ড থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই অগণিত ছাত্রছাত্রী নিহত হয়েছিলেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নূরুল্লার ধারণকৃত ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ছাত্রদের দিয়েই জগন্নাথ হলের মাঠে গর্ত খোঁড়া হচ্ছে, আবার সেই গর্তেই ছাত্রদের লাশ মাটিচাপা দেওয়া হচ্ছে। অনেক ঘরবাড়ি ও পত্রিকা অফিস, প্রেসক্লাবে আগুন ধরিয়ে, কামান ও মর্টার হামলা চালিয়ে সেগুলো বিধ্বস্ত করা হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় শাঁখারীপট্টি ও তাঁতীবাজারের অসংখ্য ঘরবাড়িতে। ঢাকার অলিগলিতে, বহু বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হত্যাকাণ্ড শুরুর প্রথম তিন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে লাখ লাখ নর-নারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ঢাকার প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়।’

২৫ মার্চের প্রথম টার্গেট ছিল জগন্নাথ হল। কারণ পাকিরা জানতো এবং বিশ্বাস করতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার নেপথ্য শক্তি আওয়ামী লীগ, মুক্তবুদ্ধির মুসলিম সমাজ আর হিন্দু জনগোষ্ঠী। এই তিন শক্তিকে পদানত করার জন্য তারা বেছে নিয়েছিল জঘন্য এক হত্যাকাণ্ড। যে হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। সে রাতে যে নির্মম তাণ্ডব ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল তার জন্য বিন্দুমাত্র আফসোস ছিলো না পাকিদের । 

উল্টো তারা কি বলতো শুনুন, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ড্যান কগিন টাইম ম্যাগাজিনে এক লেখায় এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের উদ্ধৃতি প্রচার করেন, ‘আমরা যে কাউকে এবং যেকোনো কিছুকে হত্যা করতে পারি। কারও কাছে আমাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না।’ আন্তর্জাতিক মহলের মতেও ১৯৭১ সালে ‘তিন মিলিয়ন’ বা ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। এই সংখ্যার সমর্থন আছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন, এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা ও কমটন্স এনসাইক্লোপিডিয়ায়। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী নিজের ডায়েরিতে লেখেন, তিনি বাংলার সবুজ মাঠকে রক্তবর্ণ করে দেবেন। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় ১৩ জুন ১৯৭১ প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট প্রকাশ করেন। পৃথিবীর মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ৯ মাসে এত মানুষ হত্যা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়াই ছিল মুশকিল। একমাত্র খুলনার চুকনগরেই ২০ মে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।

এতো কিছুর পরও আমাদের হুঁশ হয়নি। হবে বলে মনে ও হয় না। গণহত্যা বিষয়টা খুব সহজ কিছু না। নাৎসি বর্বরতার এতো বছর পরও বিদেশে নানা দেশে এসব নাৎসি ববর্রদের ধরে এনে বিচার করা হয়। পোল্যান্ডে গণহত্যার দায়ে জার্মানির শীর্ষ নেতা মাফ চেয়েছেন। আদালত তাকেও ছাড় দেয়নি। ছাড় দেয় না নব্বই বছরের বৃদ্ধকে। বয়স যাই হোক, হত্যার লাল খুন যাদের হাতে তারা মানবিকতা ও মানুষের দুশমন। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশে গণহত্যার তীব্রতা হলোকাস্টকেও ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৮০,০০০ নিরপরাধ মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল নাৎসিরা। কিন্তু পাক সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ৯ মাসে সে রেকর্ড ভেঙে দেয়। একাত্তরে তারা প্রতি মাসে গড়ে নাৎসিদের চেয়ে ৫ গুণ বেশি—অর্থাৎ প্রায় ৪ লাখেরও বেশি বাঙালিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ধর্ষণ করে অগণিত মা-বোনকে। সাথে অন্যান্য অরাজকতা তো আছেই। অস্বাভাবিক হারে গণহত্যা করেছে পাকিস্তানিরাÑ৯ মাসে তারা প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে ২ লাখেরও বেশি নারীকে। 

এরপরও আমেরিকা চীন তা মানেনি। বাস্তবতা হচ্ছে ভারত যদি তখন পাশে না দাঁড়াতো বাংলাদেশে পোড়া মাটি নীতির অনুসরণকারী পাকিরা কাউকে ছাড় দিতো না। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেনারেল নিয়াজীসহ ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে বিচার করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির পর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীসহ তারা দেশে ফিরে যায়। এর প্রধান কারণ চার লাখ বাঙালি পাকিস্তানে আটকে ছিলো এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো তাদের বিচার করার ঘোষণা দিয়েছিলন। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ২০০ জন বাঙালিকে কারারুদ্ধও করেছিলো পাকিস্তান। ২৫ মার্চের অভিযানটি শুরুর আগে প্রতিটি বিদেশি সাংবাদিককে ঢাকা থেকে বের করে দেওয়া হয়। স্থানীয় প্রচারমাধ্যমের ওপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক লুকিয়ে থাকেন। তাদেরই একজন সাইমন ড্রিং। তিনি ৩১ মার্চ লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’Ñএ তাঁর প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। 

দীর্ঘ প্রতিবেদনের শুরুটা এ রকম, ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর ঢাকা মহানগরী মুহুর্মুহু তোপধ্বনিতে প্রকম্পিত হতে থাকে। সর্বত্র বোমা-বারুদের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। টিক্কা খান বর্বর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে নির্মমভাবে গণবিদ্রোহ দমনে সচেষ্ট হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের প্রধান কার্যালয় পিলখানা সেনা-অভিযানে বিধ্বস্ত হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর সেনাবাহিনী নির্বিচারে ভারী আর.আর.গান, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ব্যবহার করে। ইকবাল হলকে তারা প্রধান আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। সেখানে প্রথম ধাক্কাতেই ২০০ ছাত্র নিহত হয়।

একদিকে হলগুলোর দিকে উপর্যপুরি শেল নিক্ষেপ করা হতে থাকে, অন্যদিকে চলতে থাকে মেশিনগানের গুলি। দুদিন পর্যন্ত পোড়া ঘরগুলোর জানালা-দরজায় মৃতদেহ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। পথে-ঘাটে মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। জগন্নাথ হলেও বর্বরোচিত আক্রমণ চালানো হয়। কয়েক শত ছাত্র, যারা প্রায় সবােই হিন্দু ধর্মালম্বী, নিহত-আহত হয়। সৈন্যরা মৃতদেহগুলোকে গর্ত খুড়ে গণকবর দেয়। এরপর ট্যাংক চালিয়ে মাটি সমান করে।

উপরের কথাগুলো আমার নয়। এসব ই ইতিহাস। লিপিবদ্ধ ইতিহাস। আজ সময় এসেছে ইতিহাসকে শুদ্ধ করার। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদে স্বীকৃত এই দিনটিকে গণহতভা দিবস হিসেবে পালন করে। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হলে চলবে না। আমাদের সামনে এখনো কাজ বাকি। জাতিসংঘে এর প্রকৃত স্বীকৃতি ও পাকিস্তানের মাফ চাওয়া নিশ্চিত করা দরকার। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি সবাই এ বিষয়টিতে সহমত। অল্পকিছু রাজাকার দেশ বিরোধী ব্যতীত বাকিরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে এ কাজ একদিন হবেই। কোনো দেশের যুদ্ধাপরাধীরা ছাড় পায়নি। পাকিস্তানিরাও পাবে না। এটাই ইতিহাসের পাঠ। লেখক: কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়