শিরোনাম
◈ চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন, নিয়ন্ত্রণে ১২ ইউনিট ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী

প্রকাশিত : ২১ মার্চ, ২০২৩, ১২:৩৬ রাত
আপডেট : ২১ মার্চ, ২০২৩, ১২:৩৬ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

শিক্ষা, দুর্নীতি এবং আমাদের উন্নয়ন

ড. মঞ্জুরে খোদা

ড. মঞ্জুরে খোদা: শিক্ষা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাকে বাদ দিয়ে চলা অসম্ভব। এই শিক্ষা নিয়ে কৃতি মানুষেরা অনেক জ্ঞানের কথা বলেছেন, যা শিক্ষার সংজ্ঞা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্লেটোর মতে, ‘শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা সবই শিক্ষার উদ্দেশ্যে অন্তর্ভুক্ত’। জন ডিউই বলেছেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মউপলব্ধি’। পার্কারের মতে, ‘পূর্ণাঙ্গ মানুষের আত্মপ্রকাশের জন্য যে সব গুণাবলী নিয়ে শিক্ষার্থী এ পৃথিবীতে আগমন করেছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সে সব গুণাবলীর যথাযথ বিকাশ সাধন করা’।

সুতরাং শিক্ষার একটা অর্থ ও মানে আছে। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার অবস্থা দেখে মনে হয় বই-খাতা নিয়ে স্কুল-কলেজ গিয়ে কিছু পড়ালেখা করাই ছাত্রদের কাজ। শিক্ষার পাঠ-কাঠামোয় কিছু পরিবর্তন এনে জোড়াতালি দিয়ে যুগ যুগ ধরে তা চালনো হচ্ছে। এতে শিক্ষার গুণ-মান বৃদ্ধির বদলে দিনদিন নিম্নমুখী হচ্ছে। তা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ দেখলেই বোঝা যায়, এ জন্য বাড়তি গবেষণার দরকার নেই। আমাদের শিক্ষা কতটা রোগাক্রান্ত, বিশৃঙ্খল তার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে, প্রাথমিকের বৃত্তিপরীক্ষা ও বৃত্তিপ্রাপ্তির ফলাফল প্রকাশের ঘটনা। শিক্ষা মানুষের জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ঘটছে তার উল্টো। শিক্ষার পরিমাণ ও পরিসরের বৃদ্ধিকে যারা শিক্ষার গুণমানের পরিবর্তন মনে করেন, চিকিৎসা সেখানে দরকার। কারণ তারা হয় শিক্ষার দর্শনের জ্ঞান রাখেন না, আর না হয় কোনো দূরভিসন্ধি নিয়ে এগুলো করছেন। 

বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে যে বিশৃঙ্খলা চলছে তা প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু চিত্র চিন্তা করলেই পরিষ্কার হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রধানত সরকারদলীয় শিক্ষক, ছাত্র সংগঠনের দখল ও  কর্তৃত্ব বিরাজমান। ছাত্রদের জোড় করে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ানো, ছাত্রনেতাদের পদবাণিজ্য, ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা নিত্যদিনের। শিক্ষার্থীদের শাসক দলের ইচ্ছে-অনিচ্ছার উপর চলতে হয়। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ থেকে ঠিকাদারী কাজেও তাদের নিয়ন্ত্রণ।

শিক্ষাখাতে দুর্নীতি, অনিয়ম, বিসিএস, মেডিকেল, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক ভুলে ভরা, সাম্প্রদায়িকীকরণ, বিজ্ঞান শিক্ষা হুমকির মুখে ও নিম্নমুখী। শিক্ষার ফলাফল ঊর্ধ্বমুখী হলেও মান নিম্নমুখী। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র নয় যেন এক একটি কারাগার। শিক্ষা নিয়ে এমন অনেক কথা বলা যায়, কিন্তু এ অবস্থা কোনোভাবেই শিক্ষার মান উন্নয়নের ইংগিত করে না। 

এই বঞ্চিত, অপমানিতদের একাংশ যখন সরকারি চাকরি ও পদপদবি পেয়ে উপরে উঠবে তখন তারাই হয়তো কর্তৃত্বপরায়ন ও দুর্নীতিবাজ হয়ে ওঠে। কারণ ছাত্রাবস্থাতেই তারা বুঝে গেছে নীতি, আদর্শ, নৈতিকতায় এখানে কাজ হয় না। কাজ করে শুধু কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা। এটাই সমাজের সম্মান ও মর্যাদার শর্ত। তা না থাকলে কী হয় সে অভিজ্ঞতা তাদের শিক্ষাজীবনে হয়েছে। 

১ মার্চ ডেইলি স্টার বিমানের উপর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গত বছর বাংলাদেশ তার বোয়িং ৭৭৭ বিমানের পাইলট ঘাটতি মেটাতে জরুরি ভিত্তিতে ১৪ জনের একটি ব্যাচকে নিয়োগ দেয়। একবছর পর এ ১৪ জনের মধ্যে মাত্র ৫ জনই সফল হয়। বাকি ৯ জনের মধ্যে কারো ছিলো জাল সার্টিফিকেট, কারো অযোগ্যতা এবং কারো লাইসেন্সিং পরীক্ষায় ব্যর্থতা। 

বিমান কর্তৃপক্ষ এই অযোগ্য ব্যাক্তিদের সরকারি খরচে একবছর প্রশিক্ষণ করিয়েছে। বিমান তাদের পেছনে এ অর্থ খরচ করেছে যেন তাদের আর বাড়তি খরচ করতে না হয়। অকৃতকার্যদের মধ্যে ছিলো বিমানের পদস্থ কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজন। এমন চিত্র শুধু বিমানে নয়, সব গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা-প্রতিষ্ঠান-মন্ত্রণালয়ে পাওয়া যাবে। বোয়িং ৭৭৭ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী বিমান। তার পাইলট নিয়োগে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে ভাবুন আমাদের বিমান কাদের হাতে। আমরা কাদের হাতে আমাদের জীবন তুলে দিচ্ছি। 

বিমান চালানোর মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গাতেও কতো বড় দুর্নীতি, ভাবতেই শরীর শিউড়ে ওঠে। যেখানে সরাসরি মানুষের জীবনের প্রশ্ন জড়িত। যেকোনো যাত্রীবাহী বিমান দুর্ঘটনায় মানুষের বাঁচার সম্ভবনা প্রায় শূন্য। এভাবেই ভুল চালকের হাতে যদি দেশের সবকিছু চলে যায় তাহলে ভাবুন জাতির ভবিষ্যতে কেমন হবে? শিক্ষার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক। শিক্ষার মাধ্যমেই নাগরিকদের আত্মিক, মানসিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মূল্যবোধের উন্নতি ঘটে। একইসঙ্গে এর মাধ্যমে নাগরিকরা কাক্সিক্ষত ও প্রয়োজনীয় কর্মক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জন করে। আমাদের শিক্ষা কি সেই আকাক্সক্ষা অর্জন করতে পারছে? বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে তার শিক্ষার সম্পর্ক কতোটুকু? এই বিষয়ে সমন্বিত ও সুষম কোনো গবেষণা আমার চোখে পড়েনি। কোনো ধরনের শিক্ষা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। সেই খাতের বিনিয়োগের প্রাপ্তি-ফলাফলের হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।  
 
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজনীয় দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করতে পারছে না। যাওবা হচ্ছে তাদের বড় অংশ বাইরে চলে যাচ্ছে। যারা দেশে থেকে যায় তাদেরও একটি অংশ কোনো একপর্যায়ে কর্মক্ষেত্রে বা নানা বিড়ম্বনায় স্বীকার হন। সরকারি হিসেবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটির উপরে। উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে বেকার তরুণরা চাকরি পাচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বিদেশি শ্রমশক্তির প্রভাব বাড়ছে। এ সব কিছুই শিক্ষাপদ্ধতি ও ব্যবস্থার সংকট-সীমাবদ্ধতাকেই নির্দেশ করে। 
 
শুরুতে বলেছি, শিক্ষার গুন-মান বৃদ্ধিতে বিভিন্ন সময় যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা অপরিকল্পিত, কোনো সুনির্দিষ্ট গবেষণা-জড়িপের ভিত্তিতে নয়। তা করা হয়েছে উন্নত দেশের অনুকরণে। দেশের চাহিদা অবস্থা-বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যে কারণে একটা পদ্ধতি গ্রহণ করে পরে তা পরবর্তিন ও বাতিল করা হয়। কিন্তু তার ভালো-মন্দের কোনো মূল্যায়ন পাওয়া যায় না। শিক্ষা কোনো খেয়ালের বিষয় নয়, তা একটি বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার বিষয়। 
 
এই সংকট দূর ও বেকারদের কর্মসংস্থানের কোনো উদ্যোগ-পরিকল্পনা নেই। এই সমস্যা আজকের নয় কয়েক দশকের। শিক্ষার নৈতিক-আদর্শিক দিকের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমরা আমাদের শিক্ষাকে শ্রমবান্ধব ও বাজারমুখীও করতে পারিনি। একদিকে আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারেরা কাজ পাচ্ছে না অবৈধ পথে বিদেশ যেতে পাহার-সমুদ্রে-জঙ্গলে যেয়ে মরছে। অন্যদিকে এই দেশকেই আবার বিদেশ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ শ্রমশক্তি এদেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উঁচু বেতনের কাজ করছে।

বাংলাদেশের শ্রমবাজার দখল করে থাকা কোন শ্রমশক্তি রকেট-বিমান বিজ্ঞানী বা  এআইয়ের নয়। সাধারণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করা সুনির্দিষ্ট কতিপয় পেশার দক্ষশ্রমশক্তি এবং এই শ্রমশক্তি এসেছে আমাদের মতো অর্থনৈতিক কাঠামোর দেশ থেকে আসা নাগরিক। অথচ দেশেই এই মানের শ্রমশক্তি গড়ে তোলা কোনো কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজন সততা ও আন্তরিকতা। ২ থেকে ৫ বছরের মধ্যেই তা সম্ভব। কিন্তু সেই কাজটা আমরা করতে পারিনি, তার পরিকল্পনাও নেই। একটি অদক্ষ, অযোগ্য, আত্মমর্যাদাহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত, লোভী,  চাটুকার প্রজন্ম দিয়ে একটি জাতির উন্নয়ন কতোদূর টেনে নেওয়া যাবে? 
লেখক ও শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক। ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়