শিরোনাম
◈ গাজীপুরে হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু  ◈ বিশৃঙ্খলার পথ এড়াতে শিশুদের মধ্যে খেলাধুলার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে: প্রধানমন্ত্রী ◈ তাপপ্রবাহের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা ◈ সোনার দাম কমেছে ভরিতে ৮৪০ টাকা ◈ ঈদযাত্রায় ৪১৯ দুর্ঘটনায় নিহত ৪৩৮: যাত্রী কল্যাণ সমিতি ◈ অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধে বিটিআরসিতে তালিকা পাঠানো হচ্ছে: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ◈ পাবনায় হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি ◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সব সম্পত্তি দিয়ে দেবো (ভিডিও)

প্রকাশিত : ১৯ মার্চ, ২০২৩, ০১:২৪ রাত
আপডেট : ১৯ মার্চ, ২০২৩, ০১:২৪ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বিশ্বাস, আতঙ্ক, ব্যাংকিং এবং অর্থনীতি

গোলাম সারোয়ার

গোলাম সারোয়ার: বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সি মুডিস গত ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ঋণমান অবনমন করে যাচ্ছে। আশার কথা হলো, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এখনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে আছে। অথচ সর্ব-সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ব্যাংক ধসে পড়েছে। এই থেকে আমরা কী শিখবো? শিখবো, যত রকমের তথ্য-উপাত্ত নিয়েই আমরা কাজ করি না কেন, অর্থনীতি মূলত একটি বিশ^াসের নাম। বিশ্বাস করলে ছাপানো কাগজকে আমরা অর্থ ভেবে নিতে পারি। বিশ্বাস না করলে এটি কাগজই। অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হলো ব্যাংক। ব্যাংক মূলত একটি বিশ্বাসের সত্তা। একটি ব্যাংক যুগ যুগ ধরে প্রবল প্রতাপে বেড়ে উঠতে পারে। পৃথিবীর সব রেটিংর কোম্পানির রেটিংয়ে যেটি ভালো ব্যাংক সেটিও ধসে পড়তে পারে দু’এক রাতে। ব্যাংক ধসে পড়ে বিশ্বাসের খেলাপে। এই বিশ্বাসভঙ্গ বাস্তব কারণে ঘটতে পারে। গুজবের কারণে সৃষ্ট আতঙ্কের কারণে ঘটতে পারে। আবার ম্যানেজমেন্টের অদূরদর্শী কোনো সিদ্ধান্তের কারণেও ঘটতে পারে। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাপারটি তুলনা করে দেখি। একটি ব্যাংক শুরু করতে উদ্যোক্তাদের পুঁজি লাগে বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু একটি ব্যাংকের মোট আমানত থাকে পঞ্চাশ হাজার, একলাখ কিংবা দেড় লাখ কোটি টাকা। এখন কোনো ব্যাংক যদি ফেল করে, তাহলে ওই সামান্য পরিশোধিত মূলধন থেকে কি ব্যাংকটি তার আমানতকারীদের দায় পরিশোধ করতে পারবে? পারবে না। কারণ ব্যাংক আমানত হিসেবে যে টাকা জনগণ থেকে সংগ্রহ করে সেটা আবার বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ীদের কাছে। সে টাকা ব্যাংক যখন খুশি ফেরত পেতে পারে না। কারণ ঋণ পরিশোধের শর্তে টাইম থাকে। আবার কিছু ঋণ মন্দ ঋণেও পরিবর্তিত হয়। তার মানে ব্যাংক বিনিয়োগের টাকা যখন খুশি তুলে আনতে পারে না। কিন্তু আমানতকারীদের টাকা ব্যাংককে দিতে হবে ‘অন ডিমান্ড’ মানে চাহিবামাত্র। এরকম অবস্থায় ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করে মোট আমানতের কিছু টাকা হাতে রেখে। সাধারণত একটি ব্যাংকে দৈনন্দিন কিছু আমানতকারী টাকা উঠাতে আসে, কিছু জমা দিতে আসে। এই ব্যাপারগুলো মাথায় রেখে ব্যাংক তাদের কিছু আমানত নগদ হিসেবে হাতে রাখে।

ব্যাংক আমানতের কত শতাংশ বিনিয়োগ করবে, এটি নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এভাবে নিরন্তর নিবিড় গবেষণা, পর্যবেক্ষণ করে আমানতকারীদের স্বার্থ এবং বিশ্বাস ধরে রাখে। আবার এভাবে বাজারে মুদ্রার কম বেশি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতিকে কাম্য গতিতে রাখে। 
বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের চার শতাংশ নগদে সিআরআর (CRR-Cash Reserve Requirement Ratio) হিসেবে রাখতে হয়। আরো একটি অংশ ব্যাংকগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখতে হয় এসএলআর (SLR-Statutory Liquidity Ratio) হিসেবে। এটি তের শতাংশ। এভাবে ব্যাংকগুলোকে এখন মোট আমানতের ১৭ শতাংশ সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। 

এভাবে ব্যাংকগুলো ভালোভাবে দৈনন্দিন ব্যবসা চালিয়ে যায়। এখন যদি কোনো কারণে আমানতকারীদের মাঝে বিশ্বাসের ঘাটতি আসে এবং সেটা যদি ব্যাপক আকারে কোনো জনগোষ্ঠীর ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আমানতকারীরা ভয়ে সমানে ব্যাংকে গিয়ে আমানত উত্তোলন করতে থাকে। যেখানে কোনো ব্যাংকের কোনো শাখাতে দৈনিক দু’তিন শ’ কাস্টমার গড়ে লেনদেন করতো তীব্র ভয় বা প্যানিকে সেখানে হাজার হাজার আমানতকারী একসঙ্গে টাকা তুলতে গিয়ে হাজির হয়। এই অবস্থায় ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের চেক পাস করতে ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ হয়, কারণ তাদের মোট আমানতের ৮৩ শতাংশতো বিনিয়োগ করা, যেখান থেকে সুদ পেয়ে তারা আমানতকারীদের সুদ দিতো। ঋণ অর্থাৎ বিনিয়োগের টাকা দ্রুত ব্যাংকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এভাবে যদি কোনো ব্যাংক একটি চেক অনার করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সে খবর মুহূর্তে পুরো জনগোষ্ঠীর ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। তখন দেখা যায় প্রায় সব আমানতকারী তাদের অর্থ উত্তোলন করতে ব্যাংকে গিয়ে হাজির হয়। এই অবস্থায় ব্যাংক কলাপ্স করে। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, একটি ব্যাংককে টিকে থাকতে হলে তাদেরকে বিশ্বাস জিইয়ে রাখতে হবে যে তারা যেকোনো সময় আমানতকারীদের টাকা পরিশোধে সক্ষম। এই বিশ্বাস আছে বলেই বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবসা এগিয়ে যাচ্ছে। 

স্বাধীনতার পর মাত্র ৯০০ কোটি টাকার আমানত নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো যাত্রা শুরু করে। এখন দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় মোট আমানতের পরিমাণ ১৪ লক্ষ সাতাটি হাজার কোটি টাকার উপরে। গত বছরে এই ফিগারটা আরো বেশি ছিলো। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতের আমানত ছিলো ১৫ লাখ ১২ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। এ বছর আমাদের আমানত কমেছে। কমেছে মানে কোথায় গেছে? গেছে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে মানুষের সিন্দুকে। কেন গেছে? কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গত একবছর গুজব এবং প্যানিক অতিক্রম করতে হয়েছে। আশার কথা হলো, এত গুজবের পরও আমাদের কোনো ব্যাংক কিন্তু আজও ফেল করেনি। 

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুডিসের মতো আন্তর্জাতিক রেটিং কোম্পানিগুলোর ভবিষ্যৎবাণীর অপেক্ষা না করে পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত আর সমৃদ্ধ অর্থনীতির ব্যাংকগুলোও ধসে পড়তে পারে দু’এক দিনের ভেতরে। আবার অবিরাম নেতিবাচক প্রচারণা আর গুজবের পরও আমরা টিতে থাকতে পারি। বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলোকে পথ দেখানোর জন্য বিশ্বের একটি ব্যাসেল কমিটি আছে। ব্যাসেল কমিটির সর্বশেষ টার্গেটের সবগুলো ইন্ডিকেটর পূরণ করেই একটি ব্যাংক ধসে পড়তে পারে ওভার নাইটে যদি আমানতকারীরা আস্থা হারায়। তাহলে যেটা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে সেটা হলো আমানতকারীদের আস্থা। ভুল বিনিয়োগও ব্যাংকগুলোর বিধ্বস্তের কারণ। 

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ধসে পড়ে ভুল বিনিয়োগের কারণে। ভুল মানে দূরদর্শীতার অভাবে। তারা দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করেছে। এর মাঝে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পৃথিবীর অর্থনীতি উলটপালট হয়ে যায়। সে অবস্থা মোকাবেলা করতে গিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ফেডারেল রিজার্ভকে নীতি সুদ বাড়াতে হয়। পরিণামে তারা যে হারে বিনিয়োগের ইনকাম পাচ্ছিলো তার চেয়ে বেশি আমানতকারীদের সুদ দিতে হচ্ছিলো। এভাবে তারা সংকটে পড়ে। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য তারা নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। তাতে আমানতকারীদের বিশ্বাসে ধস আসে। এর থেকে শুরু হয় গুজব আর আতঙ্ক।  

দূরদর্শীতা এমন একটি গুণ যা একজন লিডারকে অনেক দূরের জিনিস দেখায়। একজন দূরদর্শী নির্বাহীও তাই অনেক দূরের বিষয় মাথায় রেখে তার সব সম্পদ এক সেক্টরে এবং এক টেনরে বিনিয়োগ করবেনা। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের এই ব্যাপারে চিন্তার ঘাটতি অবশ্যই ছিলো। আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো অর্থনীতির একটি ব্যাংক ফেল করা মানে শুধু সে ব্যাংক ফেল করা নয়। একটি ব্যাংক ফেল করা মানে পুরো অর্থনীতি বিপদের মুখোমুখি হওয়া। একটি ব্যাংক ফেল করলে অন্য ব্যাংক থেকেও মানুষ ভয়ে টাকা তুলে নিতে পারে। ইতোমধ্যে সিলিকন ভ্যালির পর আমেরিকার সিগনেচার ব্যাংকও বন্ধ হয়ে গেছে। 

পৃথিবী এখন অনেক বেশি ইন্টারকানেক্টেড। একটি ব্যাংক ধসে পড়লে অন্য ব্যাংকের ঝুঁকি থাকে। আবার একটি অর্থনীতি ধসে পড়লে অন্য অর্থনীতিও ধসে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বে। তাই আমেরিকার ব্যাংক বিপদে পড়া মানে আমরা নিরাপদ তা বলা যাবে না। বরং আমাদের ঝুঁকি আরও বেশি সামনে চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ব্যাংক বিপর্যয়ের ঢেউ ইতোমধ্যে তাবত বিশ্বের শেয়ারবাজারে ধাক্কা দিয়েছে। এই অবস্থায় আমাদের যা করণীয় তাহলো, ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। নানা অনিয়ম, অভিযোগ আর গুজবের পরেও আমাদের আমানতকারীরা আমেরিকার জনগণের মতো বিশ্বাস হারায়নি। সেজন্য আমাদের জনগণকে ধন্যবাদ দিতে হবে। 

শেষ করবো দর্শন দিয়ে। গ্রিক স্টোয়িক দার্শনিক এপিকটেটাস বলেছেন, ‘সম্পদ আপনার চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। আপনার যা আছে, তার চেয়ে আপনার চাহিদা কম হলেই আপনি ধনী। আর আপনার যতই থাকুক না কেন, আপনার চাহিদা যদি তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আপনি দরিদ্র।’ এই কথাটি আমাদের ব্যাংক শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল পক্ষকে স্মরণে রাখতে হবে। তবেই আমাদের অর্থনীতি বর্তমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলা করতে পারবে। সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়