শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা ◈ জনগণকে সংগঠিত করে চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করতে হবে: মির্জা ফখরুল

প্রকাশিত : ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ০১:৪২ রাত
আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ০১:৪২ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

শেখ জোবায়ের আহমেদের জন্য আনোয়ারার মানুষ কাঁদলেন কেন?

শরিফুল হাসান

শরিফুল হাসান: ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে মাত্র ১৭০০ মানুষ সৎ, যোগ্য ও মানবিক ভালো হলে গোটা দেশকে বদলে ফেলা সম্ভব এমন কথা আমি প্রায়ই বলি। তাঁর একটা উদাহরণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জোবায়ের আহমেদ। প্রায় চার বছরের দায়িত্ব পালন শেষে তিনি আনোয়ারা ছাড়লেন। বিদায়ের সময় তিনি কাঁদলেন, সবাইকে কাঁদিয়ে গেলেন। এক সাংবাদিকরে নিউজে দেখলাম, এক বৃদ্ধ নারী কান্না করছেন উপজেলা চত্বরে বসে, টিয়ুনু বলে যাইবগু? (ইউএনও নাকি চলে যাচ্ছে)। শুধু এই বৃদ্ধ নয় কান্না করেছেন বহু মানুষ। সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। পদোন্নতি ও বদলিজনিত কারণে একজন ইএনও এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন, যাবেন এটাই তো স্বাভাবিক। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন ইউএও জুবায়ের কী এমন করেছে যে তাকে নিয়ে লিখতে হবে বা এতো আবেগী হতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আপনি নিজে আনোয়ারায় একবার ঘুরে আসতে পারেন কিংবা ওই এলাকার যে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।

সদা হাস্যজ্জ্বোল বিনয়ী সদালাপী জোবায়ের আহমেদ ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে আনোয়ারা উপজেলা ইউএনও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে তিন বছরে দুইবার জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমে সারাদেশের মধ্যে সেরা উপজেলা হয়েছে আনোয়ারা। সরকারিভাবে এর স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। করোনাকালীন সময়ে সাহসী পদক্ষেপের কারণে জোবায়ের প্রশংসিত হয়েছেন পুরো চট্টগ্রাম জেলায়। সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর দরজা ছিল খোলা। যখন যে সমস্যা নিয়ে মানুষ গেছে নৈতিক হলে সমাধান করেছেন। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কাছে সমান গ্রহণযোগ্য ছিলেন। সবার উপকার করেছেন অকপটে। সবার শোক-দুঃখের কথা মন দিয়ে শুনতেন, উপকার করেছেন সাধ্যমতো। কখনো তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির কথা শুনিনি। সেবা দেওয়ার পাশাপাশি আনোয়ারাকে গুছিয়েছেন তিনি। আধুনিক ও মডেল উপজেলা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। উপজেলায় স্মৃতি সৌধ, শহীদ মিনার, জাতির জনক বঙ্গবঙ্গু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য, খেলা মাঠ তৈরি, আখতারুজ্জান শিশু পার্কসহ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছেন পুরো পরিষদ চত্বরকে। এমন অসংখ্য কাজ আছে তাঁর।

সদা হাস্যজ্জল জোবায়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত ছোট ভাই বলে বলছি না বাবার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামের আনোয়ারার সিইউএফএল সারকারখানার সরকারি কোয়ার্টারে আমার শৈশব কেটেছে। আনোয়ার অনেক লোকজনকে আমি চিনি। চিনি সেখানকার অনেক সাংবাদিককে। তারাও একই কথা বলছেন। অন্যদের কথা কী বলবো, এই ইউএনও দায়িত্ব পালনকালে আমি নিজে মানবপাচার, অনিয়মিত অভিবাসন ও বিদেশফেরতদের সচেতন করার একটি প্রোগ্রামে আনোয়ারায় গিয়েছি। আমাদের টিম নিয়মিত চট্টগ্রামে কাজ করে। জুবায়েরের কাজ, জুবায়েরর সদা হাস্যজ্জ্বল মুখ, মানুষের জন্য সবসময় কিছু করার চেষ্টা, যেকোনো মোনুষের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার চেষ্টা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। 

ফেসবুকে একজন লিখেছেন, আমি এই পর্যন্ত অনেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেখেছি। কিন্তু উপজেলা নির্বাহী অফিসার জোবায়েয়ের বিদায় ভিন্নরকম। মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন তিনি। আরেকটা কথা, ওই এলাকার সংসদ সদস্য ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ কখনো প্রশাসনের কাছে হস্তক্ষেপ করেছেন বলে শুনিনি। এর মানে রাজনীতিবিদরা চাইলে এবং কর্মকর্তারা সৎ হলে অনেককিছুই সম্ভব! আমি নিশ্চিত আনোয়ারা ভবিষ্যতে যতো ইউএনও আসবে সবাই তাঁর মধ্যে জুবায়েরকে খুঁজবে। জুবায়ের যে মান তৈরি করে এসেছে তাঁর কম হলে সবাই বলবে জোবায়ের মতো কেউ এলো না! কথা হলো, দেশের নানা প্রান্তে নানা পেশায় এমন অল্প কিছু জোবায়ের হয়তো আছে। কিন্তু এই দেশের অধিকাংশ কর্মকর্তা কেন জোবায়েরের মতো হয় না? কেন তারা সবাই এমন ভালোবাসা পাওয়ার মতো কাজ করে না? কেন অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগ ওঠে? কেন তারা টাকা আর ক্ষমতার চেয়ে ভালোবাসা পেতে চায় না? তাহলে তো এই দেশের চিত্রটা বদলে যেত!

আমি প্রায়ই বলি, ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে মাত্র ১৭০০ মানুষ সৎ হলে গোটা দেশ বদলে যাবে। কীভাবে শুনবেন? দেখেন, বর্তমান মন্ত্রিসভার পূর্ণ মন্ত্রী ২৫ জন, প্রতিমন্ত্রী ১৯ জন ও উপমন্ত্রী  তিনসহ মোট ৪৮ জনের মন্ত্রিসভার নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সত্যি সত্যিই যদি এই ৪৯ জন সৎ হন, এর সঙ্গে ৩০০ জন সংসদ সদস্য, ৮২ জন স, দুর্নীতি কমিশনের প্রধান থেকে শুরু করে শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা, অর্ধশত সরকারি প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক বা প্রতিষ্ঠান প্রধান, সবমিলিয়ে মোটামুপাঁচশজন মানুষ তাহলে দেশটা মোটামুটি ঠিক হয়ে যেত। এর পরের ধাপে যদি যুক্ত করেন ৬৪ জন ডিসি, ৪৯২ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা, তিন বাহিনীর প্রধান, একজন আইজিপি, ৬৪ জেলার ৬৪ জনসহ পুসুপার মর্যাদার কয়েকশ কর্মকর্তা, শ পাঁচেক থানার ওসি, বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্তা, প্রধান বিচারপও আপিল বিভাগের সাতজনসহ হাইকোর্টের প্রায় একশ বিচারপ, শ খানেক জেলা জজ ও চীফ মেট্টোপলিটন  ম্যাজিষ্ট্রেট, অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর, গোটা ৫০ ব্যাংকের এমডি। 

দেখবেন সব মিলিয়ে মোট সংখ্যা দাঁড়াবে ১৭০০ এর মতো। এই ১৭০০ জন ঠিক থাকলে এই বাংলাদেশে কোন অনিয়ম হবে না।  নথিপত্র ঘেঁটে এবং আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণে দেখেছি, এই ১৭০০ মানুষ ঠিক নেই বরং তাঁদের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ অংশগ্রহণ বা নিরবতায় সব অন্যায় অনিয়ম হয়। সরকারি নানা প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, চুক্তি, বিদেশে টাকা পাচার, থানা থেকে শুরু করে ডিসি অফিস, সরকারি দপ্তর সব জায়গায় যাদের রক্ষক হওয়ার কথা ছিল তাদের অনেকেই আজ ভক্ষক। অর্থাৎ যাদের কাজ ছিল দুর্নীতি ও অনিয়ম ঠেকানো তারাই আজ অনিয়ম  দুর্নীতি করেছে। অথচ এই ১৭০০ মানুষ ঠিক থাকলে সেটি হতে না। কারণ এরাই নীতি নির্ধারক। 

শুধু সরকারি না বেসরকারি খাত, ব্যাংক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা যে কোনো কিছুই এই দেশে কোনো না কোনোভাবে সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর সেটি নিয়ন্ত্রণ করেন এই ১৭০০ মানুষ। আপনি যেই খাতের দুর্নীতির কথাই বলেন না কেন এই ১৭০০ মানুষ ঠিক হলে সেটা বন্ধ হবেই। পাশাপাশি দেশে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠোমো গড়ে উঠবে। দেশটাও ঠিক হবে। দেখেন কথায় কথায় এখন এই দেশের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সবাই বঙ্গবন্ধুর কথা বলেন। কিন্তু দ্নুীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো কেউ মানেন না। ১৯৭৫ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রদত্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন।করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ।  

১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষ্যে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একদল লোকের পয়সার লোভ অত্যন্ত বেড়ে গেছে। পয়সার জন্য তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মাঝে মধে মনে হয়, এখন তাদের মূলনীতি লুটপাট আর দুর্নীতি।' না বঙ্গবন্ধুর কথা দুর্নীতিবাজরা শোনেনি। বরং তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে তাঁর দল আওয়ামী লীগ গত এক ১৫ বছর ধরে ধরে ক্ষমতায়। কিন্তু তারাও বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো অনুসরণ করেনি। ভীষণ আফসোস লাগে। মুখে মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলা লোকের সংখ্যা হুহু করে বাড়লেও বাস্তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চর্চার লোক কতোটা বেড়েছে? 

আমি মনে করি না বেড়েছে। বাড়লে তো শিক্ষা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, ভূমি থেকে শুরু করে পুলিশ আদালত, পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ওয়াসা, তিতাস, সড়ক পরিবহন, রেল প্রতিটি সেবাখাত দুর্নীতিগ্রস্ত হতো না। কারণ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানেই সৎভাবে বেঁচে থাকা। বঙ্গবন্ধু আদর্শ মানে সবার কথা ভাবা। ন্যায্য কথা বলা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানলে তো রাজনীতির নামে কেউ ভণ্ডামি করতো না, রাজনীতি করে নিজের আখের গোছাতো না, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করতো না।

দেখেন কোটি কোটি জনগণকে গালি দিয়ে লাভ নেই, শুধু দা¡শীল ব্যক্তিরা ঠিক হলেই গোটা দেশটা বদলে যেতো। কিন্তু আদৌ কি এই ১৭০০ মানুষ ঠিক হবেন? আমার জানা নেই। স্বাধীনতার ৫২ বছর তো হয়ে গেল। আর কবে ঠিক হবে এই দেশ? আমাদের যারা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন ভাবনা নেই তারা আর কবে একটা সুন্দর বাংলাদেশ পাবো? কবে একযোগে ১৭০০ জন ভালো মানুষ আসবে এবং তারা এই দেশটাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবেন? আর কবে? লেখক: অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান, ব্র্যাক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়