শিরোনাম

প্রকাশিত : ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ০১:০৮ রাত
আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ০১:০৮ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অসুখের নাম ‘বাসনা’!

আহসান হাবিব

অসুখের নাম ‘বাসনা’!

আহসান হাবিব
[২] মানুষের মৌল অসুখের নাম বাসনা। বাসনার অতৃপ্তি তাকে চির অসুখী বানিয়েছে। বেঁচে থাকার অভিপ্রায় তার প্রথম বাসনার নাম। ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে’: বাঁচতে হলে তাকে লড়তে হয়, সংগ্রামে লেগে থাকতে হয়। সংগ্রাম প্রকৃতির বিরুদ্ধে, নিজ প্রজাতির বিরুদ্ধে। ফলত তার আর সব বাসনা উঁকি দিতেই এখানে এসে হোঁচট খায়। দ্বিতীয় বাসনা আধিপত্যের জন্ম এই সংগ্রাম থেকেই উদ্ভূত, ফলত এটি সে বজায় রাখতে প্রাণপণে লড়ে যায়। কেউ জেতে, কেউ জেতে না। যে জেতে তার একটি বাসনা আপাত পূরণ হলেও সংশয় এসে ভিড় করে। সে তখন হারাবার ভয়ে ভীত এবং তটস্থ হয়ে পড়ে। সংগ্রাম তার পিছু ছাড়ে না। অথচ আধিপত্য জারি হতেই ধেয়ে আসে আরো বাসনা আরো বাসনা। এই বাসনার নাম ভোগ। নানা ধরনের ভোগ।
আধিপত্যের রাজনৈতিক প্রকাশ হচ্ছে শাসন। অন্যকে শাসন করার অভিপ্রায় নাই, এমন মানুষ বিরল। কিন্তু শাসন নয়, অধিকাংশই শাসিত হয়। এটা তাকে চির অসুখের কারণ। আবার যে মুষ্টিমেয়রা শাসন করে, তারা চিরদিন শাসন করতে পারে না। একসময় তাদের মসনদ খসে পড়ে, তখন তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। যখন তারা শাসক, তখন আরো শাসক হতে চায় যেন এটা শেষ না হয়। সেটা অসুখের আর এক ধরন।
[৩] ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’ : মানুষ শারীরিকভাবেই অসুস্থ জন্মগ্রহণের পর থেকেই। যে কোন একটা না একটা অসুখ লেগেই থাকে। এটা শারীরিক মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে। জন্মগত অসুখ নিয়েও পৃথিবীতে অজস্র মানুষ আসে। কারো হার্টের, কারো মস্তিষ্ককের, কারো কোন অঙ্গের কারো আবার জিনের। 
এরাও বাঁচতে চায়। কারণ বেঁচে থাকার আনন্দ জন্মেই সে পেতে থাকে। চোখ মেলে তাকানোর ইচ্ছা তার ক্ষমতার বাইরে হলেও প্রাণের ধর্মেই সে চোখ খুলে। তখন সে সুন্দরের প্রেমে পড়ে। অবশ্য অসুখ ততক্ষণে তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। ধরুক, এখন বাসনা তার বেঁচে থাকা।

[৪] Life is disease, death is health : মানুষ যখন বৃক্ষ থেকে মাটিতে নেমে এলো, তখন প্রথম সে কামনা করলো একটি মাথা গোঁজার ঠাই। লতাপাতা ইত্যাদি বানালো সে একটা কোনরকমে থাকার ঘর। পাখীর নীড়ের মতই তা ছিল ছোট, ভঙ্গুর। তারপর তার বাসনা ক্রমে আকাশ ছুঁলো। আগুন তাকে সভ্যতার রাজপথে এনে দাঁড় করালো। বাড়িঘর, রান্না, ফসল উৎপাদন ইত্যাদি তার চাহিদাকে বাড়িয়ে তুললো। সেই লতাপাতা মাটির ঘর আজ অতীত কাহিনী। এখন তার প্রাসাদ না হলে চলে না। মার্বেল পাথরে সাজানো প্রাসাদেও মানুষের বাসনা তৃপ্ত নয়, তার চাই চাঁদে বসবাস। তার মানে এই নয়, মানুষ এখনো বাস করে না মাটির ঘরে, করে, তাদের বাসনা নিদেনপক্ষে একটি করোগেটেড টিন ছাওয়া একটি বাসা।

[৫] ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ : সমাজ বিকাশের ধারায় যখন এই পুঁজিবাদ নামক ব্যবস্থার অধীন হয়ে পড়লো, তখন প্রধান দুটি প্রান্তিক শ্রেণি তৈরি হয়ে পড়লো। একদিকে সর্বহারা অন্যদিকে পুঁজিপতি। তাদের উভয়ের বাসনা ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির। একদল স্রেফ বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত, আর এক দল আরো সম্পদ কুক্ষিগত করায় আসক্ত। শোষিতের দল স্বপ্ন দেখে এলদিন তারা ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে, একদল চেষ্টা চালিয়ে যায় নিজেদের আধিপত্য, ক্ষমতা ধরে রাখার। উভয়ের বাসনা বিপ্রতীপ।

[৬] ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই’ : দুই প্রান্তিক শ্রেণীর মাঝখানে পড়ে থাকে আরো একটা শ্রেণি, এদের একটা গালভরা নাম আছে- মধ্যবিত্ত। এদের বাসনা আবার ঐ দুই শ্রেণি থেকে আলাদা। এরা প্রায়ই পুঁজিপতিদের কাতারে যেতে চায়, তাদের সতত চেষ্টা যেন তারা নীচে গড়িয়ে না পড়ে। একদল আবার নিজেদের শ্রেণীচ্যুত করে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিতে চায়। এরা সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে বিপ্লবী সাজে। তাদের বাসনা বিপ্লব করে নিজেদের শাসক পর্যায়ে উন্নীত করবে। ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছেও। কিন্তু বাসনা তৃপ্ত হলেও ধরে রাখা সম্ভব হয়নি, তবে বাসনার মৃত্যু হয়নি, দেশে দেশে সে লড়াই চলছে।

মধ্যবিত্তের একটা অংশ নিজেদের নিয়োজিত করে শিল্প চর্চায়। তাদের অবচেতনে জমা হতে থাকা বাসনার অতৃপ্তি  চালান করে দেয় শিল্পে। তারা কবিতা লেখে, ভাস্কর্য গড়ে, নাটক বানায়, ছবি আঁকে। সৌন্দর্য নির্মাণের ছলে তারা নিজেদের অতৃপ্ত বাসনাকে মুক্তি দেয় এইসব শিল্পে। একটা কবিতা লেখা হয়ে গেলে তারা মুক্তি পায়। লিবিডো যেমন মুক্তি পায় নিষ্ক্রমণে, হয় মাস্টারবেশন কিংবা ইন্টারকোর্সে। শিল্প তাই অতৃপ্ত বাসনার কেলাসিত রূপ। যে কোন শিল্পের দিকে তাকিয়ে দেখুন, দেখবেন হাহাকার। নিজেরা কিছু করতে না পারার ব্যর্থতাগুলি শিল্পের মধ্য জমা রাখে। যারা সুন্দর সমাজ নির্মাণ করতে সংগ্রামশীল, তাদের কাছে ছুঁড়ে দেয় তাদের বাসনার রূপ, সংগ্রামীরা সেসবের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কেউ কেউ। সফল হলে তারা নিজেদের বাহবা দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় প্রথম ভাষণে তাই শেখ মুজিব বলেছিলেন: গুরুদের তোমার কথা মিথ্যা হয়ে গেছে, আমার বাঙ্গালি আজ মানুষ হয়েছে। কেননা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাত কোটি মানুষেরে হে মুগ্ধা জননী/রেখেছ বাঙ্গালি করে মানুষ করনি।
এই যে মধ্যবিত্তরা শিল্প চর্চা করে, তারাও কিন্তু এটার মধ্য দিয়ে অমর হতে চায়। মৃত্যুর পর যেন তারা তাদের শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে, তার জন্য তারা নিজেদের শিল্প কর্ম নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। নানারকম মানদণ্ড দাঁড় করায়। এক কবিতা কি এই নিয়ে অজস্র মত আছে। প্রতিটি আলাদা। এইসব মতামতে নিজেদের ঠিক বলে এক প্রকার দাবী থাকে। তাদের বাসনা একটাই- নিজেদের অমরত্ব।

[৭] ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ : বাসনাই মানবপ্রজাতির টিকে থাকার শ্রেষ্ঠ ট্রিগার। নিজেদের সভ্য করতে তারা যত বাসনার জন্ম দেয়, প্রাণীজগতে তা বিরল। মানুষের বাসনার অপর নাম সংস্কৃতি নির্মাণ। সামাজিক বিকাশের পথ ধরে সংস্কৃতির উৎকর্ষ তাই প্রধান সৃজনশীলতা। কিন্তু যত যা কিছু সে সৃজন করেছে, কিছুতেই সে তৃপ্ত হয়নি। একটা বাসনা মিটে গেলে আর একটা এসে দাঁড়িয়েছে। মিটে গেছে বলে থেমে যায়নি কিছুই। এর মধ্যে সে জেনে ফেলেছে সেই মহাসত্যটি- বিনাশই তার পরিণাম। ফলত বাসনা চরিতার্থতাই তার হৃদয়ে আকাঙ্ক্ষা হয়ে জেগে থাকে। ‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই/বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে’। লেখক: ঔপন্যাসিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়