শিরোনাম
◈ জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি ◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সব সম্পত্তি দিয়ে দেবো ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ আইনজীবীদের গাউন পরতে হবে না: সুপ্রিমকোর্ট ◈ তীব্র গরমে স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা আরও ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা ◈ সিরিয়ায় আইএসের হামলায় ২৮ সেনা নিহত ◈ সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, পতন অনিবার্য: রিজভী  ◈ সরকারের বিরুদ্ধে অবিরাম নালিশের রাজনীতি করছে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের ◈ বুশরা বিবিকে ‘টয়লেট ক্লিনার’ মেশানো খাবার খাওয়ানোর অভিযোগ ইমরানের

প্রকাশিত : ২৯ জানুয়ারী, ২০২৩, ০১:০৯ রাত
আপডেট : ২৯ জানুয়ারী, ২০২৩, ০১:০৯ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ধর্ম-বিজ্ঞান-দর্শন

কামরুল আহসান

কামরুল আহসান: বিজ্ঞান হচ্ছে ইহজাগতিক সমস্যার একটা টুল, ধর্ম হচ্ছে মূলত পরকালের পাথেয়, আর দর্শন হচ্ছে, বার্ট্রান্ড রাসেলের ভাষায়, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে একটা বেওয়ারিশ এলাকা আছে, সেই জায়গাটা নিয়ন্ত্রণ করে দর্শন। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে বেওয়ারিশ এলাকা কোনটা? এমন অনেক প্রশ্ন আছে যার উত্তর ধর্ম কিংবা বিজ্ঞানের আলোকে দেওয়া সম্ভব নয়। যেমন, কিছু না থাকার বদলে কেন কিছু আছে!

প্রশ্নটা মার্টিন হাইডেগারের। কলিজা কাঁপিয়ে দেয়ার মতো প্রশ্ন। এ-প্রশ্ন ভিতরে নাড়া দিলেই ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞানের ব্যাপারে কৌতূহলী হওয়া সম্ভব। এ-প্রশ্ন জন্ম হওয়ার পরে পদার্থবিজ্ঞানীরাও ভাবতে শুরু করলেন, সত্যিই তো, কেন কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে? নাও তো থাকতে পারতো। এরপর বিজ্ঞানীরা জগতসৃষ্টির বিগ-ব্যাং থিওরির পাশাপাশি ইনফ্লেশন থিওরি নামে একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন। মহাবিস্ফোরনের বদলে সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে মহাস্ফীতি থেকে। বিগ ব্যাং থিওরি অনুযায়ী আগে মহাবিশ্ব ছিল পুঞ্জিভূত শক্তি আকারে, একদিন সেটা উত্তপ্ত হয়ে প্রচণ্ড শব্দে ফেটে যায়, তারপর মহাজগতের বিস্তার হয়। মহাস্ফীতি তত্ত্ব অনুযায়ী একদিন সব ছিল শূন্য, সেই শূন্যতার মধ্যে ফোটকা সৃষ্টি হওয়ার মতো মহাজগত ফুলেফেপে ওঠে। ভালো কথা, যতই তত্ত্ব আসুক, সেই সত্য স্পষ্ট হয় না কেনই-বা এসব ঘটছে! ঘটছে কতকাল ধরে! আমরা যে- জগতে আছি বিজ্ঞানীদের ধারণা, এর বহুবার লয়-সৃষ্টি ঘটে গেছে। আরও কতকাল এমন লয়-সৃষ্টি হবে তার কোনো লেখাজোখা নেই। 

ধর্মগতভাবে আমরা এই জগতের একটি মাত্র চক্র মেনে নিয়েছি। এমন কি হতে পারে পৃথিবীতে আরো বহুবার কেয়ামত হয়ে গেছে। এখনও কোথাও শেষ বিচার চলছে? কোথাও এখনো অবস্থিত আছে স্বর্গ-নরক! আমরা জানি না। আরজ আলী মাতুব্বর একটা প্রশ্ন করেছিলেন, ঈশ্বর কেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে জগত সৃষ্টি করলেন? জগত সৃষ্টি করার আগে ঈশ্বর কী করছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর ধর্ম বা বিজ্ঞানের আলোকে দেয়া সম্ভব না। প্রশ্নকর্তার মন যে তাতে নিস্তার হয় তা না। মানুষের স্বভাবধর্মই হচ্ছে সে প্রশ্ন করবে। যতদূর পর্যন্ত প্রশ্ন করতে করতে সে যেতে পারে ততদূর পর্যন্ত তার জীবন। একটা পর্যায়ে গিয়ে বেশির ভাগ মানুষই হাল ছেড়ে দেয়, ক্লান্ত হয়ে পড়ে, প্রশ্নের দুয়ারে জীবনের তরে খিল লাগিয়ে দেয়। যেমন ধরুন, হযরত ইব্রাহীম নবীর পরম অনুসন্ধানের বিষয়টিই যদি স্মরণ করি। আমরা জানি জীবনের এক পর্যায়ে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, এই অপরূপ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা কে? প্রথমে তিনি সূর্যকেই ইশ্বর ভেবেছিলেন। এত তেজ যার সে সর্বশক্তিমান না হয়ে পাড়েই না। রাতে সূর্য ডুবে যেতে দেখে এবং চাঁদ উদিত হতে দেখে ভাবলেন চাঁদই ঈশ্বর, এত কোমল সুন্দর! সকালে দেখলেন চাঁদও ডুবে যায়, আবার সূর্য উদিত হয়। পরে তিনি ভাবলেন এই চাঁদ-সূর্য কেউই ঈশ্বর নয়, ঈশ্বর হচ্ছেন তিনি যিনি এসব সৃষ্টি করেছেন। 

কিন্তু তিনি কে! এই প্রশ্ন তিনি আর করেননি। যদি তিনি আরো প্রশ্ন তুলতেন তাহলে জটিলতায় পড়ে যেতেন। সেই ঈশ্বরের রূপ দিতে হতো। একমেবাদ্বিতীয়ম সেই ঈশ্বরকে নিরাকার রূপ দিতে দুহাজার বছর লেগেছে। ঈশ্বর যে নিরাকার রূপ পেয়েছেন তাতেও দর্শনের ক্ষতি হয়েছে। কারণ শব্দদ্বারা সেই ঈশ্বরকে আর ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। সসীম শব্দদ্বারা অসীম ঈশ্বরকে বোঝা কী করে সম্ভব! এখানে এসে ধর্মের আরো একটি মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হয়, সেটি হচ্ছে, যা অসীম অনিবার্যভাবেই তাকে বিলীন হয়ে যেতে হবে! কারণ, অস্তিত্ব থাকলেই তাকে পদার্থের ধর্ম পালন করতে হবে। আর যদি পদার্থ হিসেবে কিছুর অস্তিত্ব থাকে, এমন কি, নূর বা আলো হিসেবে থাকলেও তার ওজন নির্ধারণ সম্ভব। পরমঈশ্বর কী রূপে আছেন, তিনি ওজন নির্ধারণ ও গণনার বাইরে কিনা এটা একটা ভাববার মতো প্রশ্ন বটে।

ধর্মের এমন অনেক বিষয় আছে প্রশ্ন করলে যার উত্তর পাওয়া যায় না। ধর্মবেত্তারা তাই প্রশ্ন করতেও নিষেধ করেন। আবার বিজ্ঞানও যে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে তাও না। আবার বিজ্ঞান বিজ্ঞান করছি, কিন্তু, বিজ্ঞান কোনো একক বিষয় নয়। বিজ্ঞানের হাজারটা উপাদান হাজারটা পদ্ধতি হাজারটা বিষয় আছে। বিজ্ঞান একটা পদ্ধতির নাম যার মধ্য দিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান খোঁজা হয়। প্রথমবার কিছু আবিষ্কার হলে সেটা বিজ্ঞান হলেও পরে যতবার সেই জিনিশ বানানো হবে সেটা নিছক পণ্য হিসেবে গণ্য হবে। কেচি যখন প্রথমবার আবিষ্কৃত হয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে একটা অসামান্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ছিল, এখন সেটা চুল কাটার একটা যন্ত্র। বিজ্ঞান এক জিনিশ, বিজ্ঞানমনস্কতা আবার আরেক জিনিশ। স্বয়ং কোনো বিজ্ঞানী বিজ্ঞানমনস্ক নাও হতে পারেন। আবার বিজ্ঞানচর্চা না করেও কেউ বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারেন। বিজ্ঞানমনস্ক মানে ইহজাগতিক সমস্যার ইহজাগতিক উপায়ের ওপর ভরসা রাখা, কোনো আদিভৌতিক আধ্যাত্বিক বিশ্বাস না করা। 

বিজ্ঞানের এক সময় এমন জয়জয়কার শুরু হয়েছিল যে বিজ্ঞানশক্তির নাম দিয়ে উপনিবেশ বিস্তার শুরু হয়েছিল সারা পৃথিবীতে। বিজ্ঞানহীন মানুষকে নাম দিয়েছিল তারা বর্বর। মানুষ এক সময় বিজ্ঞানের আলোকেই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবে এমন আশা করেছিল। পরে দেখল বিজ্ঞান একটা অস্ত্র। বিজ্ঞান পণ্য হিসেবে উৎপাদিত হচ্ছে। বিজ্ঞান তার নিয়ন্ত্রণে যার হাতে আছে অর্থের ক্ষমতা। এবং লিয়োতার একটা সুন্দর তর্ক তুলেছিলেন, দর্শনের সহযোগিতা ছাড়া বিজ্ঞান নিজেকে জ্ঞান হিসেবেই প্রমাণ করতে পারে না। 

যাই হোক, এখন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধীতা করতে গিয়ে ধর্ম আবার ফিরে আসছে আদিমরূপে!
 উত্তর-আধুনিকরা ধর্মের জায়গা ছেড়ে দিচ্ছেন মানবিক গুণ বিবেচনা করে। অর্থাৎ, যার যার অনুভূতি তার তার, কারো অনুভূতির ওপর হামলা করা যাবে না। কথাটা অনেকটা ‘লাকুম দিনুকুম অলিয়া দিন’-এর মতো। তোমার ধর্মকর্ম তোমার, আমার কর্মফল আমার। উদারনৈতিক জায়গা থেকে প্রত্যেকের এ-স্বাধীনতা সমাজে বলবৎ থাকলে ভালো হতো। কিন্তু, জনপরিসর এমন একটা জায়গা যেখানে ক্ষমতা তার মতাদর্শ পুস করে ও পোস্ট করে। জনপরিসরের কিছু নিয়ম আছে, কিছু সামাজিক সুসভ্য ধ্যান-ধারণা এখানে প্রচলিত থাকে, আপনি না মানলেও এগুলো পাশ কাটিয়ে চলতে হবে। তা না-হলে বৃহত্তর বাজার টিকবে না। 

কিন্তু বাংলাদেশের জনপরিসর নানা কারণে ব্যহত হচ্ছে। প্রধান কারণটাই হচ্ছে এখানে নতুন কথা বলার জায়গা নাই। নতুন কথা এখানে হুমকিস্বরূপ। পুরনো সব কথা চলতে পারবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, কারণ সমাজ একটা নির্দিষ্ট কাঠামোতে বাঁধা পড়ে থাকতে চায়। এর অনেকগুলো কারণ আছে। একটা কারণ হচ্ছে বর্তমান সরকার নিজের দলটির একটি ধর্মীয়রূপ দিয়েছে। অর্থাৎ নিজেদের ইতিহাসের একটা নিজস্ব নির্দিষ্ট বয়ান বা কাঠামো তারা হাজির করেছে এবং এর বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু এখানে এখন অনেকটা ধর্মীয় মহাপুরুষের মতোই আবির্ভূত হয়েছেন। আদিম অনেক ধর্ম পিতৃপূজা থেকেই বিকশিত হয়েছে।

আরেকটা কারণ হচ্ছে উন্নয়নের জোয়ার বিজ্ঞাপন সাধারণ মানুষ  বিশ্বাস করেছে। ফলে সবাই একটু উপরে উঠতে চায়। অর্থাৎ বাজারের স্থিতিশীলতা চায়। যদিও বাজার প্রচন্ড অস্থির। বাজার বলতে শুধু কাঁচাবাজার না, আমি বুঝাচ্ছি সামগ্রিক দেন-দরবারের জায়গাটা, অর্থাৎ ব্যক্তির যতখানি ভোগ্যক্ষেত্র আছে, সে এখানে অস্থিরতা চায় না, অস্থিরতা চায় না মানেই প্রশ্নহীনতা, প্রশ্নহীনতা মানেই ধর্ম । সে যে-ধর্মই হোক, বিজ্ঞানও যখন প্রশ্নহীন হয়ে পড়ে সেটাও ধর্মে রূপ নেয়।  দর্শন এই কাজটা করে, সে শুধু প্রশ্ন ছোড়ে মারে। এখন আওয়ামী লীগের উদাহরণটা দিলাম এ কারণে যে, একটা রাজনৈতিক দলই যদি নিজেকে ধর্মীয় রূপ দিতে চায় এর প্রভাবে ইশ্বপ্রেরিত ধর্মের কী অবস্থা হবে বোঝাতে। 

যাই হোক, বিজ্ঞান এক সময় দর্শনের মৃত্যু ঘোষনা করেছিলো। এখন বিজ্ঞান টের পাচ্ছে কত ধানে কত চাল! দর্শন ছাড়া বিজ্ঞান, যেকোনো জ্ঞানই কচু পাতার পানি। দর্শনই প্রকৃত জ্ঞান, কারণ নিজেকে সত্য প্রমাণ করতে সে কখনো গলাবাজি করে না। সব জ্ঞানকে এক করাই  তার কাজ। তার কাজ সব জ্ঞান নেড়েচেড়ে দেখা, যাচাই-বাছাই করা। আমাদের সমাজে দর্শনচর্চা নেই। মানে প্রশ্ন আদতে নেই। এটা কারো ব্যক্তিগত দোষ না, পুরো জাতি এরকম একটা রূপ নিয়ে নানা কারণে। তার স্বরূপ অনুসন্ধান করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। ‘বাঙালি মুসলমানের কপাল’ নামে একটা লেখা লিখবো ভাবছি। লেখক ও সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়