শিরোনাম
◈ জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন ◈ ইরানের ইস্পাহান ও তাব্রিজে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা, ৩টি ভূপাতিত (ভিডিও) ◈ ভেটোর তীব্র নিন্দা,মার্কিন নীতি আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লংঘন : ফিলিস্তিন ◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংসদে আইন পাশ করব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক

প্রকাশিত : ০৭ ডিসেম্বর, ২০২২, ০২:৫১ রাত
আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর, ২০২২, ০২:৫১ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অথ : ফুটবল সমাচার

ড. সেলিম জাহান

ড. সেলিম জাহান: ‘আপনি কোন দলের সমর্থক?’-চায়ের কাপটি আমার সামনে নামিয়ে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলেন বন্ধুপত্নী। দুই-তিন দিন আগের কথা। বিশ্বকাপ নিয়ে বাঙালি-আবেগ একেবারে তুঙ্গে, সেটা ঢাকাতেই হোক কিংবা লন্ডনেই হোক। আমি এসেছি বন্ধুর বাড়িতে একটু গল্প করতে, একটু চা খেতে। মাঝেমধ্যেই আসি এখানে। দম্পতিটি ভারী পছন্দের আমার- স্বামী, স্ত্রী দুজনেই। দীর্ঘদিনের পরিচয়। স্বামীটি আমার ছোটবেলার বন্ধু- স্ত্রীটিও পরিচিত ৪০ বছর ধরে, তাদের বিয়ের সময় থেকেই। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে তাদের, দুজনেই সুপ্রতিষ্ঠিত জীবনে। ভারী নিটোল শিক্ষিত, রুচিশীল এবং মায়াময় পরিবার একটি। বন্ধুপত্নীর প্রশ্ন শুনে বন্ধুর চোখে চোখ রাখি, একটু মৃদু কাশি, বাইরে চোখ ফিরিয়ে লন্ডনের  শেষ বিকেলের এলায়ে পড়া ডিম-কুসুম রঙের রোদ দেখি। 

জানি, এ প্রশ্ন একটি সাদামাটা সরল নির্দোষ প্রশ্ন নয়। এতোদিনে শিখে গেছি এর পরতে পরতে জিলেপির প্যাঁচ আছে। আমার সর্বতো মূল্যায়ন এই প্রশ্নে আমার উত্তরের ভিত্তিতেই হবে। সুতরাং সাবধান হয়ে গেলাম। মনে মনে আমার কৌশল ঝালিয়ে নিতে থাকি। বুঝতে পারি, এ প্রশ্নের তিনটে সম্ভাব্য জবাব হতে পারে। প্রথমত আমি সত্যি কথাটাই বলতে পারি যে আমি কোনো দলের সমর্থক নই, কারণ ফুটবলে আমার উৎসাহ বড় কম। কিন্তু এটি আমার জন্য সাতিশয় বিপজ্জনক। এটা বললে বন্ধুপত্নী হয়তো ভাববেন যে আমি সৃষ্টিছাড়া এক লোক। বর্তমান বিশ্বে আমি বেমানান। সমাজে আমার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হবো আমি। কেউ কেউ আমাকে নির্বোধও ভাবতে পারেন। ‘নির্বোধ’ প্রশ্নে কারো কারো শঙ্খ ঘোষের ‘পাগল’ কবিতার চার লাইনও মনে হতে পারে, ‘হাওড়া ব্রীজের চূঁড়োয় উঠুন, উর্ধ্বে চান, নীচে তাকান। দুটোই কেবল সম্প্রদায়, নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।’ 

দ্বিতীয়ত : বানিয়ে বানিয়ে আমি যেকোনো একটি দেশের সমর্থক বনে যেতে পারি। যেমন, আমি বলতে পারি যে আমি জার্মানির সমর্থক। ওই দেশটি যে খেলছে, অন্তত সেটুকু আমি জানি। কিন্তু সেখানে বিপদ হচ্ছে যে বন্ধুপত্নী যদি সেই দেশটির সমর্থক না হন, তাহলে দ্বিতীয় কাপ চা মিলবে না এই সন্ধ্যায়। সেটা এক বিরাট ক্ষতি আমার জন্য, কারণ বন্ধুপত্নী ডাকসাইটে রাঁধুনি। সন্ধ্যায় এটা সেটা চাখব ভেবেছিলাম। একটি বিরূপ জবাব দিয়ে সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করতে পারি না। সুতরাং এ কৌশলও বাদ। 

তৃতীয়ত : তাঁর প্রশ্ন তাঁকেই ফিরিয়ে দেওয়া। আমিই তাঁকে জিজ্ঞেস করতে পারি, তিনি কোন দলের সমর্থক এবং তাঁর উত্তরটা জেনে নিয়ে সেটাই তাকে ফেরত দেওয়া। হ্যাঁ, এটিই হবে আমার কৌশল। বড় আরাম বোধ করলাম। সুতরাং স্মিতমুখে বন্ধুপত্নীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনি তো খেলা সম্পর্কে অনেক জানেন। আপনি কোন দলের সমর্থক’? এ স্বীকৃতিতে তাঁর চোখে সন্তুষ্টির আভা দেখা যায় একটা। ‘আমি?’, স্বামীর দিকে একটু আড়চোখে তাকিয়ে একটু গর্বিত গলায় বললেন, ‘আমি তো আর্জেন্টিনার সমর্থক’। পেয়ে গেছি আমার উত্তর। সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘বলেন কী? আমিও তো’। সারা মুখ তাঁর উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাই? আমার ব্যাপারে পরম সন্তুষ্ট তিনি, ‘মেসি খুব ভালো না’? এবার একটু বিপদ ঘনায় আমার। কিছুতেই ‘মেসি’কে তা মনে করতে পারি না। বারবার মনে হতে থাকে নিউইয়র্কের বিরাট  কিংবদন্তি দোকান ‘মেইসির’ কথা। ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে দেন। সে মুহূর্তেই মনে পড়ে যায় একটি নাম- ‘ম্যারাডোনা’। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠি, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। মেসি তে ম্যারাডোনারই যোগ্য উত্তরসূরী’। বন্ধুপত্নীর অবয়বের প্রসন্নতায় বুঝতে পারি যে ছক্কা হাঁকিয়েছি। ‘কী যে সুন্দর কথা বলেছেন’, উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন বন্ধুপত্নী। 

‘শুনুন, আপনি রাতে খেয়ে যান না’, আহ্লাদের গলায় বলেন তিনি, ‘তারপর আমরা সবাই মিলে আর্জেন্টিনা আর সৌদি আরবের খেলা দেখি টিভিতে’। আবারও সতর্ক হয়ে বন্ধুপত্নীর প্রস্তাব বিবেচনা করি। প্রস্তাবের প্রথম অংশ প্রত্যাখান করার প্রশ্নই ওঠে না। বন্ধুপত্নীর রন্ধনকুশলতা জনে জনে জানা। বিশ্বকাপের ক্ষেত্রে এ বাড়ির মেরুকরণের কারণে প্রস্তাবের দ্বিতীয় অংশ থেকে দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। ‘খেয়ে যাবো নিশ্চয়ই। আপনার হাতের রান্না খেয়ে যাবো না, সেটা হয় নাকি?’, আশ্বস্ত করি বন্ধুপত্নীকে। ‘কিন্তু খেলার জন্য তো থাকতে পারবো না। আগেই যে অমুককে কথা দিয়েছি যে ওর সঙ্গে বসে খেলা দেখবো। আর্জেন্টিনার আরেক গোঁড়া সমর্থক কিনা!’ জানাই তাকে। কথা আমার মাটিতে পড়তে পারে না, তার আগেই  সেটা ধরেন বন্ধুপত্নীটি। ‘হতেই হবে। যাদেরই একটু আধটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, তারাই আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করবে’। আড়চোখে ভ্রু-ভঙ্গী করলেন ভদ্রমহিলা স্বামীর দিকে তাকিয়ে। তারপর হৃষ্ট মুখে উঠে গেলেন আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে।
পর্দার আড়ালে স্ত্রীর চেহারাটি মিলিয়ে যেতেই বন্ধুটি আমার ওপরে রাগে ফেটে পড়লো। ‘ফুটবল খেলার তুই কি বুঝিস? খালি বড় বড় কথা। ইস্, আবার কিনা আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়েছেন উনি’, ব্যঙ্গ করে বলার সঙ্গে সঙ্গে তার পত্নীর ভ্রাতা আখ্যা দিয়ে সে এমন একটা সম্বোধন করে আমাকে, যা বলার যোগ্য নয়। ‘আহা, রাগিস কেন?’ বন্ধুকে শান্ত করার চেষ্টা করি।’ তার চাইতে তুই-ই আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়ে যা না, তাহলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়’, পথ বাতলাই তাকে। ‘কভি নেহি’, রাগের চোটে তার স্বর চড়ে এবং ভাষাও বিজাতীয় হয়ে যায়। ‘নীতির প্রশ্নে কোনো আপোস নেই’, দৃঢ় কণ্ঠে বলে সে। ‘নীতির প্রশ্নে কোনো আপোস নেই, সে ভালো কথা। কিন্তু তা ঘরের মধ্যে চলে না ভাই,’ বোঝাই বন্ধুকে, ‘ঘরনীর ক্ষেত্রে বলতে হবে, আপোসের ক্ষেত্রে কোনো নীতি নেই। তবেই না ঘরের শান্তি বজায় থাকবে’। সে শোনে, কিন্তু তবু গোঁজ হয়ে থাকে। তারপরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। খেলার সূত্র ধরে খাবার টেবিলটাই বাক-বিতন্ডার একটি যুদ্ধ-ক্ষেত্রে পরিণত হয়। টের পাই, সেই সঙ্গে চলতে থাকে স্নায়ুযুদ্ধ। খেতে খেতে বুঝতে পারি যে বন্ধুপত্নী ও বন্ধুর চলমান কথা কাটাকাটিতে পুরো খাবার টেবিলটাই একটি ফুটবল মাঠে পরিনত হয়েছে। একজন আরেকজনকে ‘কর্ণার’ করছে, ‘ট্যাকল’ করছে, এবং ‘ফাউল’ও করেছে। 

ওই শুধু ‘গোল’ করার বাসনায়। পুরো প্রক্রিয়ায় আমি ‘লাইন্সম্যানের’ কাজ করেছি, কিন্তু ‘রেফারীর’ দায়িত্ব পালন করিনি। সবকিছুর পরে বেরিয়ে এসেছি পথে বাড়িতে আপাতত: গন্তব্যস্থল। মনে মনে ভাবলাম, বিশ্বকাপ তো আমাদের আগপাশতলা গ্রাস করেছে- ঢুকে পড়েছে আমাদের অন্দরমহলে সুতানলী সাপের মতন। ঠিক সে সময়েই মুঠোফোনের নীলচে পর্দায় ভেসে উঠল ছোট্ট খবর- আর্জেন্টিনার পেনাল্টি গোল শোধ করেছে সৌদি আরব। ফলাফল ১-১। বুঝতে পারলাম যে আমার বন্ধুর বাড়িতে এবার বুঝি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, বিশ্বকাপ তো একদিন শেষ হবেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম একটা। বাঁচা গেলো। তখনই মুঠোফোনে দেখি, আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় গোল হলো। আমি বাঁচলাম হয়তো, কিন্তু আমার বন্ধুটি? লেখক: অর্থনীতিবিদ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়