শামীম আহমেদ: আমার জীবন ও জীবিকাভিত্তিক সংযোগের জায়গা জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি। কিন্তু মনের খোরাকের জায়গা সাহিত্য ও রাজনীতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কিছু হয়। সবকিছুতেই হালকা চোখ বুলাই, অত আগ্রহ পাই না, তবে নিজেকে হালনাগাদ রাখার চেষ্টা করি। ইডেন কলেজ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তোলপাড়। আলোচনার বিষয়বস্তু মূলত নোংরামি। বিষোদগার। গালিগালাজ। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে অল্প কিছুদিন আজিমপুরের সরকারি কোয়ার্টারে থাকার সুযোগ হয়েছিল। আমরা যে কোয়ার্টারে ছিলাম সেটাকে বলত আজিমপুর এস্টেট। নিউমার্কেটের খুব কাছে, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান কলেজের উল্টো পাশে। তার খুব কাছেই ইডেন কলেজ। ইডেন কলেজ নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প আদ্যিকালের। লালবাগের এমপি হাজি সেলিম একবার বোরখা পরে ইডেনে ধরা পড়েছিল, এমন একটা গল্প মনে পড়ে। ২০০৩-৪ সালের দিকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তাম। থাকতাম ৬৮/১ নাম্বার বিল্ডিং এ। হাঁটা দূরত্বে ক্যাম্পাস, টেনে হেঁটে গেলে ১২-১৫ মিনিটের বেশি লাগার কথা না।
অথচ রিকশা ছাড়া আসা-যাওয়া করতাম না। ভাবলে অবাক লাগে। অথচ এখন কোথাও গেলে অনেক সময় গাড়ি পার্কই করতে হয় ১০ মিনিটের দূরত্বে। যাই হোক ইডেন কলেজ নিয়ে বলছিলাম। আমার আপন বোনও ইডেন কলেজে পড়েছেন। ওই সময় অল্প বয়স ছিল, মেয়েদের কলেজের পাশে থাকা নিয়ে বন্ধুরা হাসি-ঠাট্টা করত। ইডেন আর গার্হস্থ্য বিজ্ঞান কলেজের মেয়েরা দেখতে বেশি সুন্দর, এমন আলাপ ছিল নিত্যকার। সন্ধ্যাবেলা বাসা থেকে বের হলে দেখা যেত শত শত মোটর সাইকেল ফুটপাথের পাশে দাঁড় করিয়ে ছেলে-মেয়েরা গল্প করছে। তাদের খাবার খোরাক জোগাত অনেকগুলো ভ্রাম্যমান ফুচকা-চটপটি আর তেলে-ভাজার দোকান। সকালে মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙত কলেজের মেয়েদের কলকাকলিতে। উল্লেখ্য ক্লাস করার জন্য কখনও ঘুম থেকে উঠতাম না, ঘুম ভাঙলে তবেই ঘুম থেকে উঠতাম। কোন স্যারের ক্লাস না করলে জীবনে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে সেটা তখন যেমন মনে হয়নি, এত বছর পর এখনও তেমনটা মনে হয় না। ব্যাপারটা দুঃখজনক হলেও সত্য। তবে আবুল বারকাত স্যারের ক্লাস করতে ভাল লাগত। উনি মজা করে কথা বলতেন। ক্লাসের সবাইকে বলতেন আপনি করে, আমাকে বলতেন তুমি করে। কেউ কেউ এইজন্য আমাকে বেশ হিংসাও করত।
ফিরে যাই ইডেন কলেজে। ইডেন কলেজ নিয়ে যেসব ঢালাও মন্তব্য শুনছি আশেপাশে, তাতে বেশ খারাপ লাগছে। একটা কলেজ, প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যর্থ হতে পারে, তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছুতে নাও পারে, কিন্তু সেখানে পড়া সব শিক্ষার্থীকে একযোগে খারাপ তকমা দেয়া একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কোন একটি ছাত্র সংগঠনের কারণে, শিক্ষকের কারণে, কিছু শিক্ষার্থীর কারণে, রাজনীতির কারণে, প্রশাসনের ব্যর্থতায় তাদের সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু মনে রাখা দরকার একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত প্রতিটি মানুষ খারাপ হতে পারে না। আমি যখন আজিমপুর এস্টেটে থাকতাম, এক সন্ধ্যায় আমার সাথে দেখা করতে এসে আমার এক বন্ধু বলল, ‘আহা সব উচ্চপদস্থ ঘুষখোরদের জায়গা। সবাই ঢুকেই নিশ্চয় এদের গালি দেয়, তোর খারাপ লাগে না’?। আমি তাকে বলেছিলাম আমার খারাপ লাগে না কারণ আমি জানি আমার বাবা কেমন, আমার বাবাকে যারা চেনে, তারা তার সামনে শ্রদ্ধায় মাথা অবনত করত। একজন সৎ সরকারি কর্মকর্তার ছেলে হিসেবে আমি তখনও গর্ববোধ করতাম, এখনও করি। অসৎ কর্মকর্তাদের সন্তানেরা হয়ত নানাভাবে উপকৃত হয়েছে, আমার চাইতে অনেক কম যোগ্যরা ২০ বছর আগে এসে দক্ষিণ আমেরিকার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বাবার টাকায় বাড়ি-গাড়ি কিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু সেটা স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রাপ্য ছিল না। আমি জানতাম ওই কোয়ার্টারে থাকা অনেক সরকারি কর্মকর্তারই অঢেল টাকা ছিল, কিন্তু তার জন্য ঢালাওভাবে সব সরকারি কর্মকর্তাকে অসৎ, দূর্নীতিবাজ তো বলা যায় না। ইডেন কলেজে এখন কত ছাত্রী পড়ালেখা করে আমি জানি না, কিন্তু আমি জানি তাদের মধ্যে একজন ছাত্রীও যদি কোন ধরণের অপকর্মের সাথে জড়িত না থাকে, তাকে এখন এই সমাজে কী ভীষণ অপমানিত হতে হচ্ছে, কী নিদারুন অপরাধী সাজতে হচ্ছে।
অথচ এটা কারও অজানা নয় পতিতাবৃত্তি, মাদক ব্যবসা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, দালালি, টেন্ডারবাজির সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, নর্থ সাউথসহ দেশের সব পাবলিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রশাসন, শিক্ষার্থীর কেউ না কেউ জড়িত আছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, এর প্রতিটি আমি সেখানে হতে দেখেছি। ব্যাপকভাবেই দেখেছি। আমার বন্ধুরা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, কলেজে পড়েছে, সেখানেও এর কোন ব্যাত্যয় তারা দেখেনি। ইডেন কলেজে যা হচ্ছে তা সমর্থন করি না, প্রতিকার চাই, প্রতিরোধ চাই। কিন্তু এভাবে একটা কলেজকে, সেই কলেজের নামকে যাতে আমরা সমাজে ট্যাবু না বানিয়ে ফেলি। আমাদের ‘সোশাল ট্রায়ালের’ কারণে ইডেনের কোন নিরপরাধ মেয়েকে যাতে সমাজে অপদস্থ হতে না হয়। বন্ধু, পরিবার, প্রতিবেশীর কাছে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার না হতে হয়। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় টিটকারির শিকার না হতে হয়। এমনকি এইসব কর্মকান্ডে জড়িত যারা, তাদেরকেও বিচারের দায়িত্ব কেউ আমাদের হাতে তুলে দেয়নি। মানুষ অনেক সময় অনেক অসহায়ত্বের কারণে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, অনেক সময় পরিস্থিতির শিকার হয়, তাদেরকে ফিরে আসার পথ খুঁজে দিতে হবে। যদি না পারি, অন্তত যাতে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন না করি, সেই বিষয়টা মাথায় রাখা জরুরী। একজন অপরাধীকে শাস্তি দেয়া জরুরী, কিন্তু তার চাইতে অনেক বেশি জরুরী একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে অপরাধীর তকমা মাথায় নিয়ে শাস্তি না পায়, সেটি নিশ্চিত করা। লেখক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
আপনার মতামত লিখুন :