শিরোনাম

প্রকাশিত : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:২০ রাত
আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:২২ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সাফ চ্যাম্পিয়ান, মাতৃপক্ষের বোধন 

নবনীতা চক্রবর্তী:


নবনীতা চক্রবর্তী: যারা প্রকাশ্যে বলে ৭৫ এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার ,যারা বলে বর্তমান সময়ের চেয়ে নাকি পাকিস্তানী আমল ভালো ছিল , এসব শুনে দেখে বুঝে মাঝে মাঝে কপালে ভাঁজের চিহ্ন দেখা দিলেও গত দুইদিনের বাংলার অদম্য মেয়েদের দুরন্ত জয়ে শিরদাড়া কেমন  সোজা হয়ে উঠল । ফুৎকারে উড়ে গেল সমস্ত চিন্তা ।দ্বিধার পাহাড় ভেঙ্গে চুর চুর । যে আগামীর  বাংলাদেশের বীজ  বুনে যাই অবিরাম সেইখানে এমন যোদ্ধাদের বিজয় আমাদের শুধু সুখ দেয় না দেয় সাহস আর আত্মবিশ্বাস । সাফ চ্যাম্পিয়ন আমাদের বাংলার মেয়েরা । ‘’আহা কি আনন্দ / আকাশে বাতাসে /গাছে গাছে পাখি ডাকে / কত শোভা চারিপাশে ‘’। 

মানুষের কলতানে আবেগে আর উচ্ছ্বাসে ,উল্লাসের মহাসমারোহ বাংলাদেশ দেখল। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে একদিন কূপমুন্ডুকেররা নারীদের বন্দি করতে চেয়েছিল হাজার গায়েবি ফতোয়ার অজুহাতে আর সেইখানেই আজ জনতা বাঘিনীদের বরণ করেছে মহানন্দে । এ থেকে একটি  সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে,বাংলার ধর্মপ্রাণ সাধারণ জনগণ সেই ধর্মজীবীদের প্রত্যাখ্যান করেছে । বাংলাদেশ দেখল সকল কাঁটা চুর্ণ করে কি করে ফুল হয়ে উঠতে হয় । মেয়েরা যেন শিকল পরেই সেই শিকল ভাঙ্গাটা আমাদের হাতে কলমে দেখিয়ে দিল । চোখে আঙ্গুল তুলে দেখালো  বাধার পাহাড় জয় করা কাকে বলে । কত দীর্ঘ অনুশীলন কত পরিশ্রম ,কত চোখের জল ,কত রোদ বৃষ্টি ,কত দিনবদলের খেলা দেখেও নীরবে মুক্তো ফলানোর কাজটি তারা করে গিয়েছেন । মেয়েরা এক বোমা মেরেছে । সেই বোমার বারুদে ঝলসে গিয়েছে সেই কাঠমোল্লাদের বিকৃত চিন্তা ,যারা রাস্তায় মিছিল করে মেয়েদের খেলা বন্ধ করার জন্য । যাদের নিদারুন ফতোয়ায় বন্দি নারী উন্নয়ন নীতি ।ঝলসে গিয়েছে সেই সব সমাজপতিদের অবয়ব যারা বাইরে নারী উন্নয়নের হাওয়াই মিঠাই জনতাকে গেলাতে পারলেও ভিতরে ভিতরে তাদের কাছে নারীরা সেফ্র একটি পণ্য । নারীদের মানুষ হিসেবে ভাবতে ,সম্মান দিতে যাদের বড়ই কার্পণ্য । 

দারিদ্র্য ,ক্ষুধা ,সামাজিক বাধা আর বৈষম্যকে জয় করে মেয়েরা আজ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে । পুরুষতান্ত্রিকতা ও ধর্মতান্ত্রিকতার অন্ধত্বকে ছিন্ন করে সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়া ডিঙ্গিয়ে এই একেক জন যোদ্ধা হয়ে উঠেছেন আজকের বাংলাদেশ । কারন এখনও মেয়েদের খেলতে পারা বিশেষ করে একদম প্রান্তিক পর্যায়ে জন্য এক বড় প্রতিবন্ধকতা । ছেলেরা যেখানে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে সেখানে একজন মেয়েকে নিতে হয় পারিবারিক ,সামাজিক ও পেশাগত চ্যালেঞ্জ । 
ওরা ১১ জন, বাংলাদেশের নানা প্রান্তের তারা শতদল । ফুল গুলোর নাম ভারি চমৎকার সানজিদা –সাবিনা –কৃষ্ণা – নীলা ,রুপনা –ঋতুপর্না –আঁখি-মনিকা-,মারিয়া-শামসুন্নাহ্রাা। পাহাড় ,উপকূল ,সমতল , অরন্য জনপদের প্রতিনিধি তারা । নানা ধর্ম ,বর্ণ আর জনপদের সমন্বয়ে তাদের এই ঐক্যতান এক মনিহার । যা বাংলাদেশের গলায় দ্যুতি ছড়াচ্ছে । অথচ তাদের কারও হেলে পড়া ঘর ঝুপড়ি ঘর ,কারও মা সামাজিক গঞ্জনা সইতে না পেরে খেলার বলটাই কেটে দিয়েছে , পরিবারের উপরে ঝুলেছে ,নাতনী ফুটবল খেলে বলে দোযখে যাওয়ার   কারও ফতোয়া ,মাথার উপরে নেই বাবার ছায়া , কাউকে আবার বিক্রি করতে হয়েছে বোনের অলংকার ।জীবনের সাথে লড়াই করতে করতে আজ তারা বয়সের চেয়েও অনেক বেশি পরিনত । দারিদ্র , বঞ্চনা ও বৈষম্য’র কাছে হার না মানা এই জয়িতারা প্রচলিত সামাজিক প্রথা , যুক্তিহীন চিন্তা ,সংস্কারের বিরুদ্ধে দিয়েছে এক মস্ত চপটোঘাত । তারা খেলোয়াড় । নারী পুরুষ নির্বিশেষে খেলোয়াড় । তারা স্বর্ণাক্ষরে লেখা জ্বল জ্বলে ইতিহাস । যে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আমাদের রক্ত গঙ্গায় ভাসতে হয়েছে ,সখিনা বিবিদের ঘর ভেঙেছে ,সম্ভ্রাম লুট হয়েছে ,মুছে গিয়েছে হরিদাসীর কপালের সিঁদুর ,তারা সেই স্বাধীনতা । সেই আসাদের শার্টের মতো উড্ডীন প্রিয় লাল সবুজ পতাকা । 

অথচ এই তারাই  রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ’ র কবিতার মতো  সেই অবহেলা ,সেই নতমুখের মতো ছিল । প্রদীপের তলার অন্ধকারের মতো ছিল নিমজ্জিত। কোন ভ্রুক্ষেপ ছিলো না আমাদের ,তাকাবার সময় কোথায় ? কিন্তু তারাই তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করে সারাদেশকে তাদের দিকে দৃষ্টি ফেরানোর এক ভীষন কার্য সমাধা করেছে । এই জয় শুধু খেলার জয় নয় এই জয় সত্যিকারের  সামাজিক ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিনবদলের জয়ের সূচনা। সাধারন মানুষ এই যোদ্ধাদের স্বাগত জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সাথে তাদের ভ্যানগার্ড হয়ে কদম কদম এগিয়ে একাত্মা প্রকাশ করেছে । এই ট্রফি প্যারেড মানুষের সত্যিকারের ভালোবাসা ,আবেগ আর উল্লাসের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে । নারী ফুটবলার টিমের ডিফেন্ডার আঁখি কথা প্রসঙ্গে বলেছেন তারা তাদের পরিবারের শেষ সম্বল ,তারা শুধু তাদের পরিবারের শেষ সম্বল নয় তারা বাংলাদেশেরও সম্বল,রত্নআকর। অনেক কাঠ খড় পোড়ানো এই আঁখিরাই লড়াকু বাংলার সম্বল । যাদের কারনে আমাদের চোখ উস্কানি পায় দুচোখ ভরে স্বপ্ন দেখার । নতুন থেকে নতুন ইতিহাস গড়ার স্পর্ধা করার । আজ তাদের নিয়ে নানা সমাগম ,হৈচৈ ,নানা আয়োজন ,কোলাহল এবং কলরব । অনেক আশ্বাস অনেক বন্দনা, তবে জোয়ারে হয়ত গা ভাসাবেন না আমাদের জয়িতারা । অনেক হাততালি ,প্রশংসা ,বিকিকিনি আবার ক্ষেত্র বিশেষে অতি নাটুকেপনাও আছে । তবে প্রকৃত যোদ্ধারা এই সবকিছুকে ছাপিয়ে  নিশ্চয়ই অভীষ্ট লক্ষ্যে স্থির থাকবেন । একলব্যের মতো নিচল তাদের প্রত্যয়।  ফেলে আসা বাস্তবতাকে মাথায় নিয়েই শতরঞ্জির ছক কষবেন তারা নতুন আঙ্গিকে  । বিজয় যাত্রার যে শুভ নব সূচনা হয়েছে তাদের হাত ধরে তা অব্যাহত থাকবে এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের । 

সাফ চ্যাম্পিয়ান খেলোয়াড় নীলুফার ইয়াসমিন নীলার মা গণমাধ্যমকে বলছিলেন “ আমার মেয়ে যেখানে আছে সেখানে শুধু আমার মেয়ে না আরো অনেক  মেয়ে আছে সবাই আমার মেয়ে । সবাই আমার মেয়ের বয়সী । আমি আরও দোয়া করি  ওরা যেন আগায় যায় ,বাংলাদেশকে আরো কিছু দিতে পারে সেই আশাই করি ।‘’ আমাদেরও আশা ঠিক তাই । বাংলার মেয়েরা এগিয়ে যাবে শত বাধা উপেক্ষা করে নিজেদের গুনে সমৃদ্ধ করবে দেশ । সেই রত্নদের সঠিক ভাবে পরখ করে নেওয়াটাও জহুরিদের কাজ ।  বৈষম্যহীন সুযোগ প্রাপ্তি  ও সঠিক পরিচর্যায় তারা হয়ে উঠবে দেশের সম্পদ ।  যে সমতাভিত্তিক সমাজ আমরা বির্নিমান করতে চাই সেই সমাজের তারা হবেন আলোকবর্তিতা । 
 তিথিতে দেবীপক্ষের সুচনা হয়েছে । দেবী দুর্গা তথা মাতৃশক্তির বোধন সম্পন্ন হয়েছে যার পরিচিতি আমাদের কাছে মহালয়া নামে । বোধন হোক মানবতার ,বোধন হোক শুভ শক্তির ,বোধন হোক নারী শক্তির । চিন্তা ,বোধ ,বুদ্ধিতে যে দানবীয়তা যে আসুরিকতা তা নিপাত যাক । অসুর থাকবে কতক্ষন অসুর যাবে বির্সজন । মাতৃপক্ষের  শুভেচ্ছা ।  
নবনীতা চক্রবর্তী: শিক্ষক, ঢাকা ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিভারর্সিটি 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়