দীপক চৌধুরী: পদ্মা সেতু যাতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা না করতে পারেন সেই নেতিবাচক ব্যবস্থা যেকোনোভাবে করা দরকার বলে মনে করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। প্রকৃতপক্ষেই এটা তাদের গভীর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিকল্পনা ছিল। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সময় লক্ষ লক্ষ জনগণের মধ্যে যে আনন্দ দেখা গছে তা ৭১-এর বিজয়ের পরের সময়ের আনন্দ যেনো। এক কথায় বলবো, জয়তু শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতুর জন্য জয়মাল্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের জবাব দিলেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। বক্তব্যে আবেগাপ্লুত হতে দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি সেতু নির্মাণে সাহস জোগানো বাংলাদেশের জনগণকে স্যালুট জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ সেতু কেবল সেতু নয়। এর ৪২টি স্তম্ভ স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অনুযোগ নেই। আমরা নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা দেশবাসীকে নিয়ে সব সমস্যা মোকাবিলা করে যাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা আবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা মাথা নোয়াইনি, আমরা মাথা নোয়াব না। জাতির পিতা আমাদের মাথা নোয়াতে শিখান নাই।’
এখন মনে হয়; হয়তো বিরোধিতাকারীরা ধারণা করেছিলেন, নিজের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহস বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা করবেন না। কিন্তু শেখ হাসিনার শরীরে যে পিতার রক্ত রয়েছে তা সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন তারা। যদি গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলেই এ কঠিন সত্য বের হবে, প্রকাশ হবে। পিতা দিয়েছেন স্বাধীনতা আর সুযোগ্যকন্যা দিয়েছেন ও দিচ্ছেন উন্নয়ন। এদেশের জনগণ চিনতে পেরেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থ বাতিলে যারা অভিযুক্ত তারা কারা? এদের চিনেছে, জেনেছে। জবাব জনগণই দেবে। সেই দুঃসময়ে কী রকম অদ্ভুত ও অযৌক্তিক কথা উনারা বলেছিলেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যাকে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সঙ্গে মাখিয়ে বিতর্কিত করা। যাতে শেখ হাসিনা এই ঐতিহাসিক সেতু তৈরি করতে না পারেন। এর পেছনে ছিল রাজনীতি। এদেশের কিছু ব্যক্তিও যে মূলত দায়ী বেশি তা কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝিয়ে দিয়েছেন। গত বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমাদের দেশের লোক আমাদের বদনাম করে। আমাদের দুটি স্বনামধন্য পত্রিকার যারা এডিটর প্লাস মালিক, সাথে আপনাদের চট্টগ্রামের এক সন্তান আছে, নোবেল..., সুদের ব্যবসা করে জনগণের টাকা খেয়ে... সেই সুদখোর আর এডিটররা মিলে গিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টে আমাদের বিরুদ্ধে সমানে অপপ্রচার।” “আর হিলারি ক্লিনটনের (সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী) কাছে ইমেইল পাঠিয়ে পাঠিয়ে নানাভাবে যোগাযোগ করে। কাজেই পদ্মা সেতুকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলাম।”
তথাকথিত নানারকম অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “কোথায় দুর্নীতি হয়েছে তার প্রমাণ হাজির করতে বলেছিলেন তিনি। তার উপদেষ্টা মসিউর রহমান প্রমাণ চেয়ে বার বার চিঠি লিখেছেন। কিন্তু দুর্নীতির কোনো প্রমাণ বিশ্ব ব্যাংক দিতে পারেনি।”
পদ্মা সেতু বিশ্বের বুকে এক অসাধারণ চিত্র হয়ে থাকলো। মুক্তিযুদ্ধের পরে এতো বড় ও এতো সুন্দর স্থাপনা ইতিহাস হয়েই থাকবে। চমৎকার বলেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। তাঁর ভাষায়, “একজন শেখ হাসিনা আছেন বলেই পদ্মা সেতু হয়েছে।” শুধু আমরা কেনো, সারা দুনিয়া জানে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপির আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন হয় এবং লুটপাট, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, বাংলাভাইয়ের উত্থান ঘটায়। এ কারণেই জরুরি পরিস্থিতিতে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) আসে। বিএনপি দুর্নীতির কথা বলে, সুশাসনের কথা, মানবাধিকারের বলে। কিন্তু বিএনপি আমলে যে হারে বাংলাদেশে লুটপাট, সন্ত্রাস, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, ক্যু, নির্বাচনি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে তা আর কাউকে দিয়েই হয়নি এদেশে। জনগণ লাভবান হবে, উপকৃত হবে, শান্তি পাবে তা কিন্তু বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির সরকারের কোনো কাজে দেখা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে ও তাঁর ইচ্ছায় ও আগ্রহে গৃহহীনদের জন্য বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ১৯৯৬ থেকে এ পর্যন্ত ৮ লাখের বেশি পরিবারকে বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে তাঁর সরকার।
ঘুরেফিরেই পদ্মা সেতুর কথা চলে আসে। নানাকারণেই পদ্মা সেতু আমাদের আত্মমর্যাদার সেতু। বাঙালির গর্ব করার সেতু। সেই সেতু নিয়ে যখন একটি মহল নানারকম ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করলো তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই অসত্যকে রুখে দিয়েছিলেন। এ বিষয়টি নিয়ে বিবিসি’র ‘হার্ডটক’-এ অংশ নিয়ে স্পষ্টভাষায় পরিষ্কারভাবে তাঁর সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছিলেন। অনেকেই জানেন, এ সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে। পরিকল্পিত চক্রান্তের উদ্দেশ্য ছিল বহুবিস্তারী। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে বিতর্কিত করা ও ব্যর্থতা দেখানোর পরিকল্পনা ছিল সেখানে প্রোথিত। যাতে যুক্ত হয় দেশের একেশ্রেণির বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজের কতিপয় ব্যক্তি এবং আন্তর্জাতিক একটি মহল। তাদের লক্ষ্য ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পকে কেন্দ্র করে করে এটাকে দিয়ে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত করা। মূল উদ্দেশ্য ছিলো বিশ্বব্যাপী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের জনপ্রিয়তার মুখে দুর্নীতির কলঙ্ক লাগানো।
সারা দুনিয়া জানে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সৎ রাজনীতিকদের একজন। তাঁর সাহসিকতা, সততা ও দূরদর্শিতার কাছে দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করে অর্থনৈতিক সক্ষমতার উজ্জ্বলতম উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে যুক্তরা অবশ্যই ভাগ্যবান। দায়িত্ব পালনকারীরা ভাগ্যবান। পদ্মা সেতু সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক এবং অপমানের প্রতিশোধ। এই সেতু শুধু সেতু নয়, এটি প্রকৌশলজগতে এক বিস্ময়।
পাঠকদের মনে থাকার কথা, পদ্মা সেতু নিয়ে কথা বলা কমিয়ে দেয় বিএনপি তখনই যখন কানাডার আদালতের রায় পাওয়া গেল। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এই রায় হয়, যা জানা যায় এক মাস পর। সেই রায়ে বিচারক বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগকে গালগপ্প এবং উড়ো কথা বলে উড়িয়ে দেন। অথচ এর আগে? বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তোলার পর বিএনপি সোচ্চার ছিল এবং লাফাচ্ছিল দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে।
এই অর্জনকে নস্যাৎ করতে দেশে বিদেশে তাদের দোসরদেরকে নিয়ে বিভিন্ন অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতেই নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর দুরন্ত সাহসের কারণেই বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পেরেছে। একাজে তিনি জয়ী হয়েছেন।
আসলে শক্তিশালী নদীর ওপরে পদ্মা–ই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম সেতু, সুতরাং এদেশের জনগণ মনে করে, ইতিহাসের স্বার্থেই শেখ হাসিনার নাম মিশে রবে এ সেতুর সঙ্গে। পদ্মার মতো ধরনের পানিপ্রবাহ একমাত্র আমাজান নদীতে দেখা যায়। ওই নদীর ওপরে কোনো সেতু নেই। পদ্মা সেতুর পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার (ইআইএ) দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদ। তাঁর মতে, এ ধরনের শক্তিশালী নদীর ওপরে পদ্মা–ই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম সেতু।
যারা মনেপ্রাণে এই সেতু চায়নি, পদ্মা সেতু হবে একথা বিশ্বাস করতে পারেনি ওরা এখন অস্থির হয়ে গেছে। আগে মানুষ, এরপর দেশ আর তারপর রাজনীতি- এটা ওদের নীতি থেকে উধাও। তাদের আচরণ ও কথাবার্তা দেখে মনে হচ্ছে আমরা একশ্রেণির উন্মাদের প্রলাপ শুনছি প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক আলোচনায় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। অনেক রিস্ক আছে।’ বাঙালির অগ্রগতির বিরুদ্ধে অবস্থানকারীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফলতায় উন্মাদ হয়ে গেছে একটি মহল। অবশ্য তাদের চোখমুখে এখন হতাশার প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির এ অর্জন মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :