মহসিন কবির: শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ভারতীয় অঞ্চলগুলোয় একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। ত্রিপুরার এরকমই একটা গ্রাম কালীপুর। মাত্র ৪০টি পরিবারের বসবাস এই গ্রামে। কাঁটাতারের বেড়ার গায়ে সেখানকার মানুষ তাদের রোজকার পরনের জামাকাপড় শুকাতে দেন। তবে সেখানকার নিত্যদিনকার দৃশ্য পাঁচই অগাস্টের পর কিছুটা পাল্টে গেছে। শনিবার বিবিসি বাংলা এমনটাই জানিয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের চার রাজ্য––আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম আর ত্রিপুরার মোট এক হাজার ৮৭৯ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমান্ত আছে। এর মধ্যে ত্রিপুরার ৮৫৬ কিলোমিটার সীমান্তই দীর্ঘতম।
ত্রিপুরার উনকোটি জেলাতেই ৭৩ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্ত আছে, যেখানে একেবারে সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের সংখ্যা ১৫টিরও বেশি। কালীপুরও সেরকমই একটি গ্রাম। উনকোটি জেলারই আরেকটি ছোট গ্রাম সামরুরপাড়। সেখানকার বাসিন্দা দিলীপ দাসও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে খুবই বিরক্ত।
আরেকটি গ্রাম কালারকান্দির বাসিন্দা নাজমুল হুসেইনও উদ্বেগে রয়েছেন। তার বেশ কয়েকজন আত্মীয় বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। তিনি বলছিলেন, আগে বাংলাদেশে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া খুবই সহজ ছিল, কিন্তু এখন ততটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই দেশে আমার বেশ কয়েকজন আত্মীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারাও এখন সমস্যায় আছেন। অনেকেই আত্মগোপন করে আছেন, কেউ কেউ বিদেশে পালিয়েছেন।
ত্রিপুরার মনু নদীর পাশে কৈলাশহর বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত দিয়ে ঘেরা। এই শহরের সীমান্ত বাণিজ্য বহু দশক ধরে রমরমাই ছিল।
ত্রিপুরার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যকেন্দ্র এই শহর, যার সঙ্গে কয়েক হাজার মানুষের রুটি-রুজি জড়িত। কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর কথিত হামলার খবর আসার পর স্থানীয় কিছু সংগঠন বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
গত ২৭ নভেম্বর থেকে ত্রিপুরার কৈলাশহরে স্থানীয় হিন্দু সংগঠনগুলো আন্দোলন করছে। ওই দিনই তারা চাতলাপুর শুল্ক স্টেশনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। তারপর ২০ দিনের জন্য সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কৈলাশহর আমদানি-রফতানি ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রেসিডেন্ট গৌড় চন্দ্র অধিকারী বলছিলেন, এই সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ৬০-৭০ লাখ ভারতীয় টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।
এদিকে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম সীমান্তের শূন্যরেখার মধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশের বর্ডারগার্ডকে (বিজিবি) কোনো কিছু না জানিয়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। এ নিয়ে বিএসএফ ও বিজিবি উভয় সীমান্তে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করায় গোটা সীমান্তজুড়ে চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
শুক্রবার সকাল থেকে বাংলাদেশ-ভারত প্রধান পিলার ডিএমপি ৮ নম্বরের উপপিলার ৪৬ থেকে ৩৭ নম্বর সীমান্তের প্রায় অর্ধকিলোমিটারের মধ্যে বিএসএফ ৩০ থেকে ৩৫ জন নির্মাণ শ্রমিককে দিয়ে লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি খুঁটির মধ্যে প্রায় ৪ ফুট উচু কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করে। শূন্যরেখার দেড় শত গজের শেষ অংশে স্থানীয়রা এসব স্থাপন করতে দেখে বিজিবিকে খবর দেয়! ৫১ রংপুর বিজিবি ব্যাটালিয়নের পানবাড়ি ও দহগ্রাম ক্যাম্পের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বেড়া স্থাপনে বাধা দেয়। কিছু সময় নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখলেও পরবর্তীতে কয়েকশত বিএসএফ সদস্য এবং লোকজন নিয়ে আবারও বেড়া স্থাপনের কাজ করতে থাকে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই দেশের অভ্যন্তরে সীমান্তের কাছে আম বাগানের পরিচর্যা করতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে দুই যুবক আহত হয়েছে। জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার চাকপাড়া সীমান্তের বাগিচা পাড়া এলাকায় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বিরুদ্ধে আট থেকে নয় রাউন্ড গুলি ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে। গুলিবিদ্ধরা হলেন মো. শহীদুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান।
শনিবার ভোরে ১৮২ নম্বর মেইন পিলারের কাছে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। গুলির শব্দ শুনেছে বিজিবিসহ সীমান্ত এলাকার গ্রামবাসীরা। বিজিবির পক্ষ থেকে তিন রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা গেছে বলে স্বীকার করা হয়।
আহতরা শাহবাজপুর ইউনিয়নের বাগিচাপড়া গ্রামের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে শহিদুল রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং মিজানুর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। শহিদুল পেটে ও মিজানুর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। বিএসএফের শ্মশানি ক্যাম্পের সদস্যরা গুলি ছুড়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সদস্য মনিরুল ইসলাম জানান, গভীর রাতে ৮/৯ রাউন্ড গুলি শব্দ পাওয়া গেছে। আহত দুই যুবকের পরিবারের দাবি সীমান্তে বাংলাদেশের অংশে তারা আম গাছের পরিচর্যা করার সময় বিএসএফ সদস্য অতর্কিতভাবে গুলি চালালে আহতের ঘটনা ঘটে। তারা বলছেন সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিচারহীনতার কারণে বিএসএফ সদস্যরা মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশে ঢুকে গুলি চালায়।
দুই যুবক গুলিবিদ্ধের ঘটনায় আজমতপুর সীমান্তে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়।
আপনার মতামত লিখুন :