বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন: রেলের টিকিট কালোবাজারি বন্ধসহ অনিয়ম-দুর্নীতিবিরোধী বেশকিছু উদ্যোগ নিয়ে আলোচনায় আসা সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলনকে ২০২০ সালের ৬ অগাস্ট হঠাৎ বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে তখন বেশ সমালোচনা হলেও তাকে আর স্বাভাবিক দায়িত্বে ফেরানো হয়নি। ওএসডি থাকা অবস্থাতেই পরের বছর ডিসেম্বরে অবসরে যান মাহবুব কবির।
সাবেক এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, এক বছরেরও বেশি সময় আমাকে কোনো কাজই করতে দেওয়া হয়নি। ওই সময় অফিসেও গিয়েছি হাতে গোনা কয়েকবার। তবে বেতন-বোনাস নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি, ঠিকঠাক পেয়েছি। ওই সময়টা অকারণে বসিয়ে না রাখলে দেশ ও মানুষের জন্য আমি আরও অনেক কাজ করতে পারতাম। কিন্তু সেই সুযোগ না পাওয়ার আফসোস আমার বাকিটা জীবন থেকেই যাবে।
অবসর নিয়ে মিলন শেষমেশ ওএসডি থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন। কিন্তু প্রশাসনে এখনও অসংখ্য কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা চাকরিতে থেকেও রীতিমত ‘বেকার’ জীবন কাটাচ্ছেন।
এতে একদিকে যেমন মেধা ও শ্রমশক্তির অপচয় হচ্ছে, তেমনি ওএসডি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিবছর সরকারকে গুনতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
ওএসডি আসলে কী? : খাতা-কলমে ‘ওএসডি’ একটি বিশেষ ধরনের পোস্টিং বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এর পূর্ণরূপ ‘অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি’ বা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রিটিশ শাসনামলে তৎকালীন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ওএসডি’র বিধান চালু করা হয়, যার চর্চা পাকিস্তান আমলেও বলবৎ ছিল।
অতীতের রীতি মেনে স্বাধীন বাংলাদেশেও সরকারি কর্মকর্তাদেরকে ওএসডি করার নিয়ম রাখা হয়।
বর্তমানে দেশটির সংস্থাপন বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরকে ওএসডি করার বিধান রয়েছে।
এর বাইরে, অন্য বিভাগ, সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে সংযুক্ত করার নিয়ম চালু আছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
প্রশাসনিক প্রয়োজনেই দেশ স্বাধীনের পর জনপ্রশাসনে ওএসডি বিধান রাখা হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন সাবেক আমলারা।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, যেমন ধরেন, প্রাকৃতিক বা অন্য কোনো দুর্যোগের সময় বিশেষ কোনো দায়িত্ব পালন করতে হবে। তখন নিয়মিত দায়িত্বের একজন কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করে সেই কাজে নিয়োজিত করা হয়।
যেসব কারণে ওএসডি : বিশেষ দায়িত্বের বাইরেও আরও বেশ কিছু প্রশাসনিক প্রয়োজনে ওএসডি করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদে প্রশিক্ষণ বা ছুটিতে যাওয়া।
চাকরিরত অবস্থায় কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ টানা তিন মাসের বেশি সময়ের জন্য প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমন, অসুস্থতা বা চিকিৎসাজনিত কারণে ছুটি নিতে চাইলে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করে রাখা হয়।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, প্রশিক্ষণ বা ছুটিতে থাকাকালে তাদের বেতন-ভাতা যেন বন্ধ না হয়, সেজন্যই এটি করার প্রয়োজন পড়ে।
একই কারণে পদোন্নতি পাওয়ার পর একজন কর্মকর্তাকে তার নতুন পদে পদায়ন হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে ওএসডি করে রাখা হয়ে থাকে।
এছাড়া কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ প্রেষণে অন্য কোনো বিভাগ বা প্রতিষ্ঠানে গেলে কিংবা অন্য কোনো বিভাগে সংযুক্ত থাকা কর্মকর্তাকে সেখান থেকে অবসর দেওয়ার সময় ওএসডি করার প্রয়োজন হয় বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এর বাইরে, কর্মকর্তাদের কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি বা শৃঙ্খলাভঙ্গের মতো কোনো অভিযোগ উঠলে সেটির তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখার বিধান রয়েছে।
জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) আহ্বায়ক ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবেই এটি করা হয়ে থাকে যেন অভিযুক্ত কর্মকর্তা তার পদে বসে আগের মতোই অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যেতে না পারেন।
এছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে অভিযুক্ত কর্মকর্তা যেন কোনোভাবে তদন্তকাজে বাধা সৃষ্টি করতে না পারেন, সেটিও তাকে ওএসডি করার আরেকটি উদ্দেশ্য।
তবে সরকার চাইলে এসবের বাইরেও যেকোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি করতে পারে।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব কবির মিলন বলেন, এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ দেখানোর প্রয়োজন পড়ে না। জনস্বার্থে করা হয়েছে বলে অনেক সময় প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
এ ধরনের ওএসডি করা পেছনে অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও কাজ করে বলে জানিয়েছেন বর্তমান ও সাবেক আমলারা।
রাজনৈতিক ওএসডি : প্রশাসনিক প্রয়োজনীয়তার বাইরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি কর্মকর্তাদেরকে ওএসডি করার নজির রয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, বিশেষ করে গত তিন দশকে যে হারে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযৌক্তিতভাবে ওএসডির ঘটনা ঘটেছে, সেটি বেশ উদ্বেগজনক।
মূলত ১৯৯৬ সালের একটি ঘটনা রাজনৈতিক বিবেচনায় ওএসডি’র সংখ্যা বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন বর্তমান ও সাবেক আমলারা।
ওই বছর বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার পর তাদের পদত্যাগের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঢাকায় ‘জনতার মঞ্চ’ তৈরি করা হয়, যেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরাও অংশ নেন।
ওই ঘটনার পর কর্মকর্তাদের অনেকের রাজনৈতিক পরিচয় সামনে চলে আসে এবং তাদের অনেকে পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের সময় ওএসডি হন। একইভাবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিএনপি শাসনামলে পদোন্নতি পাওয়া অনেক কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়।
এমনকি সম্প্রতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরেও একইভাবে শেখ হাসিনার শাসনামলে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের অনেকে ওএসডি হয়েছেন।
জনপ্রশাসন, নৌপরিবহনসহ বেশকিছু মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবকেও ওএসডি’র সেই তালিকায় দেখা গেছে।
কিছুক্ষেত্রে আন্দোলন-বিক্ষোভের মুখেও আগের কিছু কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরাতে দেখা গেছে।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক সরকারের সময় কেউ কেউ মন্ত্রী-এমপিদের কথা না শুনে নিয়ম মেনে কাজ করতে গিয়ে ওএসডি হয়েছেন, তেমন অভিযোগও আছে।
ওএসডি কর্মকর্তারা কী করেন? : নামের শেষে ‘বিশেষ ভারপ্রাপ্ত’ থাকলেও ওএসডি হওয়া কর্মকর্তাদের বেশিরভাগেরই আদতে কোনো ভারই বহন করতে হয় না বলে জানাচ্ছেন সাবেক কর্মকর্তারা।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, প্রশিক্ষণ, ছুটি ও সংকটকালে বিশেষ দায়িত্বের বাইরে যারা ওএসডি হন, তাদের সেভাবে কোনো কাজই থাকে না। বসে বসে বেতন-ভাতা ভোগ করেন।
তবে কাজ না থাকলেও নিয়মিত কার্যালয় তথা সচিবালয়ে গিয়ে হাজিরা দিতে হয় কর্মকর্তাদের।
বিএএসএ’র আহ্বায়ক ও সচিব ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, দায়িত্ব না থাকায় সেখানে তাদের জন্য কোনো কক্ষ বা চেয়ার-টেবিল বরাদ্দ থাকে না। ফলে তাদেরকে লাইব্রেরিতে বসতে হয় এবং সেখানে রাখা হাজিরা খাতায় সই করতে হয়।
খাতা-কলমে হাজিরা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও উচ্চপদের কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই সেটি অনুসরণ করেন না বলে জানা যাচ্ছে।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব কবির মিলন বলেন, ওএসডি থাকা অবস্থায় সাধারণত যুগ্ম-সচিব বা তার উপরের পদ মর্যাদার কোনো কর্মকর্তা সেভাবে আর অফিস করেন না। কারণ গিয়ে তারা কী করবেন? কোথায় বসবেন?
মেধা ও অর্থের অপচয় : ওএসডি হওয়ার পর কর্মকর্তারা কোনো কাজ না করলেও তাতে বেতন-ভাতা আটকে থাকে না। পদ অনুযায়ী আগের মতোই বেতন-বোনাস, গাড়ি-বাড়িসহ যাবতীয় সুযোগ—সুবিধা ভোগ করেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, কাজে না লাগিয়ে সরকারের কর্মকর্তাদের এভাবে বসিয়ে বসিয়ে বেতন-বোনাস দেওয়াটা জনগণের করের টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
২০১৩ সালে হাইকোর্টে জমা দেওয়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তার আগের নয় বছরে ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার ছয়শ জন।
ওই নয় বছরে তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাবদ সরকারের ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১৫১ কোটি টাকা।
এর মধ্যে মুনির হোসেন নামে পুলিশের এক কর্মকর্তাকে প্রায় ১১ বছর ওএসডি রাখার পর ২০২২ সালে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়, যা দেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ওএসডি করার মাধ্যমে কর্মকর্তাদেরকে বেকার বসিয়ে রাখার ফলে যে মেধার পাশাপাশি যে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হচ্ছে, সেটি সরকারও স্বীকার করছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংযুক্ত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে এবং কীভাবে ওএসডি হওয়া কর্মকর্তাদের অন্য সরকারি কাজে যুক্ত করা যায়, সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে।
আপনার মতামত লিখুন :