শিরোনাম
◈ ইরানের ইস্পাহানে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা, ৩টি ভূপাতিত ◈ জাতিসংঘে সদস্যপদ প্রস্তাবে মার্কিন ভেটোর নিন্দা ফিলিস্তিনের, লজ্জাজনক বলল তুরস্ক ◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংসদে আইন পাশ করব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান

প্রকাশিত : ১৩ আগস্ট, ২০২২, ০৪:৫৬ দুপুর
আপডেট : ১৪ আগস্ট, ২০২২, ১২:৩৪ রাত

প্রতিবেদক : এম. মোশাররফ হোসাইন

কে এই সালমান রুশদি?

সালমান রুশদি

এম. মোশাররফ হোসাইন : সালমান রুশদি একজন ব্রিটিশ ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। পুরো নাম আহমেদ সালমান রুশদি, ১৯৪৭ সালের ১৯ জুন ভারতের মুম্বাইতে জন্মগ্রহণ করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। তখন ভর্তি হয়েছিলেন রাগবি স্কুলে। পরে ইতিহাসে অনার্স ডিগ্রি নেন ক্যামব্রিজের মর্যাদাপূর্ণ কিংস কলেজ থেকে। এরপর ব্রিটেনের নাগরিকত্ব নেন এবং তার মুসলিম বিশ্বাস থেকে সরে দাঁড়ান। কিছুদিন অভিনেতা হিসেবে কাজ করা ছাড়াও বিজ্ঞাপনের কপিরাইটিংয়ের কাজও করেছেন।

ব্যক্তিজীবনে সালমান রুশদি ৪ বিয়ে করেছেন। তার দুটি সন্তান আছে।

সালমান রুশদির দ্বিতীয় উপন্যাস মিডনাইটস চিলড্রেন ১৯৮১ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করেছিল। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বিশ্বব্যাপী একটি বড় আকারের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।

বইটি প্রকাশের পর বেশ কয়েকটি দেশের মুসলিমরা প্রতিবাদ জানায়, যা অনেক সময় সহিংস রূপ ধারণ করে। তাকে মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয়। ইরানের তৎকালীন প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি এই বই রচনার জন্য ১৯৮৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে ৩০ লাখ ডলার মূল্যে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করেছিল। ঘোষণায় তিনি আরও বলেন, রুশদিকে হত্যা করতে গিয়ে কেউ নিহত হলে সে শহীদের মর্যাদা পাবে এবং জান্নাতে যাবে।

এই ফতোয়া দেওয়ার চার মাসের মাথায় মারা যান খোমেনি। তবে তার সেই ঘোষণা এখনও বহাল আছে। খোমেনির মৃতুর পর এ বিষয়ে আর এগোয়নি ইরান, কিন্তু ২০২১ সালে দেশটির সরকার সমর্থিত একটি ধর্মীয় ফাউন্ডেশন পুরস্কারের অংকের সঙ্গে আরও ৫ লাখ ডলার যুক্ত করে।

২০০০ সালের পর থেকে রুশদি মূলত নিউ ইয়র্ক সিটির ইউনিয়ন স্কোয়ার এলাকায় বাস করে আসছেন। ২০০৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টায় অবস্থিত ইমোরি ইউনিভার্সিটিতে ডিস্টিংগুইশড রাইটার ইন রেসিডেন্স হিসেবে ৫ বছরের জন্য কাজ শুরু করেন। ২০০৮ সালের মে মাসে তাকে অ্যামেরিকান একাডেমি অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস এর একজন সম্মানসূচক বিদেশী সদস্য পদ প্রদান করা হয়।

সালমান রুশদি

২০১০ সালের নভেম্বরে তার রুকা অ্যান্ড দ্য ফায়ার অফ লাইফ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। সে বছরেরই শুরুর দিকে তিনি আত্মজীবনী রচনা শুরু করেছেন বলে ঘোষণা দেন।

তার বই দ্য স্যাটানিক ভার্সেস প্রথম নিষিদ্ধ হয়েছিল তার নিজের দেশ ভারতে। ফলে, মাতৃভূমি থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা-সমর্থনের আশা ছিল না। তাই খোমেনি মাথার দাম ঘোষণার পর থেকেই প্রাণ বাঁচাতে ফেরারি জীবন শুরু হয় সালমান রুশদির।

যুক্তরাজ্য তাকে আশ্রয় দিতে সম্মত হয়, তবে সরকারের তরফ থেকে শর্ত দেওয়া হয়— নাম পরিচয় গোপন করে থাকতে হবে। উপয়ান্তর না থাকায় সে শর্ত মেনে নিয়ে ‘জোসেফ অ্যান্টন’ ছদ্মনামে প্রায় ১৩ বছর ব্রিটেনে ছিলেন তিনি।

১৩ বছরে নিরাপত্তার প্রয়োজনে বেশ কয়েকবার ঠিকানা বদলাতে হয়েছে তাকে। তার এই নির্বাসিত জীবনকে আরও দুঃসহ করে তোলে তার সে সময়ের স্ত্রী মার্কিন ঔপন্যাসিক ম্যারিয়েন উইগিংনসের সঙ্গে বিচ্ছেদ। ১৯৯৩ সালে বিচ্ছেদ হয় তাদের।

নিজের ডায়রিতে এ প্রসঙ্গে নিজের ডায়রিতে তিনি বলেন, ‘এখানে আমি বন্দির থেকেও বন্দি। কথা বলার মতো একটা মানুষও এখানে নেই। পরিবারকে সময় দেওয়া, আমার ছেলের সঙ্গে ফুটবল খেলা, আর দশজনের মতো সাদাসিধা জীবন কাটানো— এটাই এখন আমার একমাত্র স্বপ্ন এবং বর্তমান মুহূর্তে মনে হচ্ছে এটি একটি অসম্ভব স্বপ্ন।’

‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’র প্রেক্ষাপট ছিল ইসলামপূর্ব আরব সমাজ এবং ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী (সা.), ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবে পূজিত তিন দেবী আল্-লাত (আলিলাত), আল্-উজ্জা (আলিজা) ও মানাহ এবং শয়তানকে উপন্যাসটির চরিত্র হিসেবে হাজির করেছিলেন তিনি।

উপন্যাসটির কাহিনী খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে ইসলামের প্রচারের সময় তৎকালীন আরবের পৌত্তলিক ধর্মাবম্বীদের দ্বারা ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হন মহানবী (সা.)। সে সময় শয়তান তাকে প্রস্তাব দেয়, মহানবী যদি আরবের পূজিত তিন দেবীকে তার হাতে তুলে দেন, সেক্ষেত্রে আরবে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। এবং মহানবী (সা.) সেই প্রস্তাব মেনে ওই তিন দেবীকে শয়তানের হাতে তুলে দেন।

যাদু বাস্তবতা (ম্যাজিক রিয়েলিজম) ঘরানায় লেখা এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগে বিক্ষোভ শুরু হয় তার বিরুদ্ধে, সেই সঙ্গে দেশে দেশে নিষিদ্ধ হতে থাকে বইটি। এ পর্যন্ত ২০টি দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। সবার আগে বইটি নিষিদ্ধ করে রুশদির জন্মভূমি ভারত।

১৯৮৮ সালে বইটি প্রকাশের পর ভারতের মুসলিমরা বিক্ষোভ শুরু করলে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী বইটি সে দেশে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন। পরের বছর, ১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় শহর ব্র্যাডফোর্ডে বিক্ষোভ মিছিল শেষে একদল মুসলিম প্রকাশে বইটির বেশ কিছু কপি পোড়ায়। তার পরের মাসে রুশদির ফাঁসির দাবিতে ইসলামাবাদে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য কেন্দ্রে হামলা চালায় হাজারেরও অধিক পাকিস্তানি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গুলি ছুড়তে হয়েছিল পুলিশকে এবং তাতে নিহত হয়েছিলেন ৫ জন।

তার মধ্যেই খোমেনির ফতোয়া পশ্চিমা বিশ্বে উস্কে দেয় ভীতি। এই ভীতির কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক ২ বছরের জন্য বিচ্ছিন্ন ছিল।

মুসলিমদের শান্ত করতে ও আত্মপক্ষ সমর্থনে ১৯৯০ সালে ‘সরল বিশ্বাসে’ (ইন গুড ফেইথ) নামে একটি নিবন্ধ লেখেন রুশদি। সেখানে তিনি স্বীকারোক্তি দেন, তার এই উপন্যাসের প্রধান এবং একমাত্র উদ্দেশ্য সাহিত্যসৃষ্টি। কাউকে আঘাত করার অভিপ্রায় নিয়ে তিনি এটি লেখেননি। কিন্তু তার এই আত্মপক্ষ সমর্থন কট্টরপন্থী মুসলিমদের শান্ত করতে পারেনি।

যুক্তরাজ্যে দুই বছরেরও বেশি সময় ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ থাকার পর ১৯৯১ সাল থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ শুরু করেন তিনি। কিন্তু উপন্যাসটি যিনি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, তিনি ওই বছরই আততায়ী হামলায় নিহত হন।

জাপানি অনুবাদক নিহত হওয়ার কয়েকদিন পর ছুরি হামলায় নিহত হন উপন্যাসটির ইতালীয় অনুবাদক ও নরওয়েতে যে প্রকাশক বইটি প্রকাশ করেছিলেন, তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

তুরস্কের লেখক আজিজ নেসিন তুর্কি ভাষায় বইটির অনুবাদ করছিলেন। এই অভিযোগে ১৯৯৩ সালে তুরস্কের মধ্যাঞ্চলীয় শহর সিভাসের একটি হোটেল ১৯৯৩ সালে জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ মুসলিমরা। সেসময় হোটেলটিতে ছিলেন আজিজ। তবে সৌভাগ্যক্রমে আজিজ নেসিন অগ্নিদগ্ধ হওয়া থেকে বেঁচে গেলেও হোটেলটিতে আগুনে পুড়ে মরেছিলেন ৩৭ জন মানুষ।

১৯৯৮ সালে ইরানের সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি অবশ্য ব্রিটেনকে আশ্বাস দেন, রুশদির ওপর জারি করা ফতোয়া কার্যকর করা হবে না। তবে খোমেনির উত্তরাধিকারী আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ২০০৫ সালে ঘোষণা দেন, রুশদি একজন ধর্মত্যাগী এবং তাকে হত্যা করা ইসলাম কর্তৃক অনুমোদিত।

এদিকে সম্ভাব্য হামলা থেকে বাঁচতে বছরের পর বছর ধরে নিজেকে লুকিয়ে রাখা রুশদি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে সামাজিক জীবনযাপন শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানেও নিয়মিত যেতেন তিনি। কট্টর ইসলামপন্থীদের রোষাণল থেকে বাঁচতে গত ৩৩ বছর ধরে মৃত্যুর ফতোয়া নিয়ে চলছেন সালমান রুশদি। নিজের জন্মভূমি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন, নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। 

কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। শুক্রবার সকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে অতর্কিত হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বিতর্কিত লেখক সালমান রুশদি। তাকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছে এবং তিনি কথা বলতে পারছেন না। রুশদি একটি চোখও হারাতে পারেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সূত্র : বিবিসি, উইকিপিডিয়া

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়