ভারতের রাজধানী এখন শোকে স্তব্ধ। সোমবার সন্ধ্যার ভয়াবহ বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন বহু প্রাণ, আহত আরও অনেকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। গোটা দিল্লিজুড়ে নেমে এসেছে আতঙ্কের ছায়া।
এমন পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে শোকের আবহ, আর ঠিক এই সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিদেশ সফরে। মঙ্গলবার সকালে দুই দিনের ভুটান সফরে রওনা হন তিনি। দেশের অভ্যন্তরে যখন কার্যত যুদ্ধ পরিস্থিতি, তখন প্রধানমন্ত্রীর এই বিদেশ সফর নিয়ে উঠেছে প্রবল বিতর্ক।
বিরোধীদের প্রশ্ন—এই ভয়াবহ সময়ে দেশের কর্ণধার কোথায়? রাজধানী রক্তাক্ত, অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রী বিদেশে কীসের সফরে?
আম আদমি পার্টির মুখপাত্র সৌরভ ভারদ্বাজের তীব্র মন্তব্য, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, ভবিষ্যতে ভারতে কোনও জঙ্গি হামলা হলে তা যুদ্ধ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। তাহলে এখন কি যুদ্ধ চলছে, আর সেই সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে?
তিনি প্রশ্ন তোলেন, দিল্লির ঘটনার ভয়াবহতা স্পষ্ট, গোটা দেশ উদ্বিগ্ন। প্রধানমন্ত্রী কি চাইলে এই সফর স্থগিত রাখতে পারতেন না? একই সুর কংগ্রেসেরও। তাদের অভিযোগ, দিল্লির বিস্ফোরণের দায়ভার এড়ানো যাচ্ছে না। কংগ্রেসের দাবি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।
দলের মুখপাত্র বলেন, দিল্লির বুকে এমন ভয়াবহ হামলার পরও যদি সরকারের দায় থাকে, তাহলে সেটা কার? জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের, তারা কি ব্যর্থ নন?
এদিকে ঘটনাস্থল ঘিরে তদন্তে নামছে একাধিক সংস্থা। সূত্রের দাবি, হামলার সঙ্গে পাকিস্তানঘেঁষা জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদের যোগ মিলেছে। প্রাপ্ত সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, বিস্ফোরণের আগে সুনহেরি মসজিদের পার্কিং লটে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছিল একটি সাদা রঙের গাড়ি, সেটিই পরবর্তীতে বিস্ফোরিত হয়।
এই সূত্র ধরে ইতিমধ্যেই দু’জন সন্দেহভাজনকে আটক করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। প্রাথমিক তদন্তেই উঠে আসছে সংগঠিত সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের ইঙ্গিত। কিন্তু এত কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও রাজধানীর কেন্দ্রে এভাবে হামলা কীভাবে সম্ভব হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে সাধারণ মানুষও।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এমন এক সময়ে যখন দেশজুড়ে নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক চরমে, তখন প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর জনমনে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে।
সমালোচকদের মতে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে কার্যত সমন্বয়ের অভাবই এই নিরাপত্তা বিপর্যয়ের মূল কারণ। বিস্ফোরণের পরও গোয়েন্দা তথ্য বা সতর্কতার অভাব নিয়ে নীরবতা পালন করছে কেন্দ্র।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ভুটান থেকেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তার বক্তব্য, আমি অত্যন্ত ভারী মন নিয়ে এখানে এসেছি। দিল্লির ঘটনায় গোটা দেশ শোকাহত। আমি তদন্ত সংস্থাগুলোর সঙ্গে সারারাত যোগাযোগ রেখেছি। ষড়যন্ত্রকারীরা কোনোভাবেই রেহাই পাবে না।
কিন্তু বিরোধীরা বলছে, এমন এক সময়ে বিদেশে থেকে বার্তা পাঠানো যথেষ্ট নয়, দেশের ভেতরে থেকে জনগণের পাশে থাকা ছিল প্রধানমন্ত্রীর নৈতিক দায়িত্ব।
দেশের জনগণ এখন উত্তর খুঁজছে—কারা দিল্লির এই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে, কেন বারবার রাজধানীর বুকেই হামলার শিকার সাধারণ মানুষ? কেন্দ্রীয় সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছিল, সেটি আদৌ কার্যকর হচ্ছে কি? নাকি সেই নীতিই আজ কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ? দিল্লির মর্মান্তিক বিস্ফোরণ যেন সেই প্রশ্নগুলোকেই আরও প্রবলভাবে সামনে এনে দিল।
যখন রাজধানী রক্তাক্ত, নাগরিকেরা শোকাহত ও আতঙ্কিত, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী বিদেশে—এই প্রতীকী চিত্র এখন ভারতে রাজনৈতিক ও নৈতিক নেতৃত্বের দায়বোধ নিয়েই নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বিস্ফোরণ শুধু গোয়েন্দা ব্যর্থতার নয়, সরকারের জনসংযোগেরও বড়সড় পরীক্ষা। আর সেই পরীক্ষায় এবার দেশের শাসকশক্তি যে কঠিন চাপে পড়েছে, তা আর গোপন নেই।
সূত্র: যুগান্তর