শিরোনাম
◈ ‎তিস্তার পানি কমলেও দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন, ‎বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব অনেক পরিবার ◈ ফরিদপুরে পদ্মায় ভরা মৌসুমেও ইলিশের হাহাকার, বাজারে আগুন ◈ একদিনে ডেঙ্গুতে প্রাণ গেল ৫ জনের ◈ সুন্দরবনের উপকূলে নোয়াপাড়ার শতবর্ষী পানের হাটে কোটি টাকার লেনদেন, তবুও চাষিদের হতাশা ◈ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কুমির গবেষণা: যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বন বিভাগ উদ্বিগ্ন ◈ পানগুছি–বলেশ্বরের রূপালি ইলিশে জেলেপল্লীতে উৎসব, নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে ◈ ভারতে লুকিয়ে থাকা আমেরিকার ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ অপরাধীকে যেভাবে ধরলো এফবিআই ◈ উপদেষ্টা আসিফের প্রেস সেক্রেটারির টেন্ডারের কমিশন নিয়ে দর কষাকষির অডিও ফাঁস (ভিডিও) ◈ উমামার নেতৃত্বে স্বতন্ত্র প্যানেল ঘোষণা: ডাকসু নির্বাচন ◈ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চান শেখ হাসিনা, দিলেন আসন্ন নির্বাচন নিয়ে নতুন ফর্মুলা

প্রকাশিত : ২১ আগস্ট, ২০২৫, ১২:০৫ দুপুর
আপডেট : ২১ আগস্ট, ২০২৫, ০৬:০২ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশের জন্য যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠছে চীনের কুনমিং শহর

চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং সিটি

চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং। ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আঞ্চলিক সংযোগের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ শহর। ‘সিটি অব ইটার্নাল স্প্রিং’ নামে পরিচিত শহরটির আবহাওয়া সারা বছরই নাতিশীতোষ্ণ। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মূল গেটওয়ে হিসেবে এটি চীনের দক্ষিণ এশিয়া নীতিতে কৌশলগত ভূমিকা পালন করে। কুনমিং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগের কেন্দ্র হিসেবে মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনামের বাণিজ্যপথে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে শহরটি। ভৌগোলিক অবস্থান, বহুপক্ষীয় বাণিজ্য মঞ্চ, আঞ্চলিক কূটনীতি এবং স্বাস্থ্য খাতের সহযোগিতা—সব মিলিয়ে শহরটি বাংলাদেশের জন্যও কৌশলগত কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। সূত্র: বণিক বার্তা 

ঢাকা থেকে মাত্র সোয়া ২ ঘণ্টার ফ্লাইট দূরত্বে চীনের কুনমিং বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসার নতুন গন্তব্য হয়ে উঠছে। ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের বিকল্প হিসেবে অনেকেই চীনের এ শহরকে বিবেচনা করছেন। বিশেষ করে ক্যান্সার, হৃদরোগ ও নিউরোসংক্রান্ত জটিল রোগের ক্ষেত্রে। কুনমিংয়ের আধুনিক হাসপাতালগুলো রোবোটিক সার্জারি, বিশেষায়িত ক্যান্সার চিকিৎসা এবং জটিল অপারেশনের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অবকাঠামো তৈরি করেছে। সম্প্রতি চীন বাংলাদেশী রোগীদের জন্য ‘গ্রিন চ্যানেল’ ভিসা সুবিধা চালু করেছে। স্বাস্থ্যসেবায় এ সহযোগিতা শুধু জনগণের উপকারেই আসছে না, বরং দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

চলতি মাসেই কুনমিং সফর করেন ২৩ সদস্যের বাংলাদেশী সাংবাদিক প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদারের নেতৃত্বে এ সফর চীন সরকারের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠিত হয়। তিনদিনের ওই সফরে কুনমিং টংরেন হাসপাতাল ও কুনমিং আই হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করেন তারা।

জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চীনের সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে কুনমিং বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের স্থান। ওখান থেকেই যাতায়াতের সুবিধা হয়। অনেক আগে থেকেই কুনমিংয়ে পিপল-টু-পিপল কানেক্টিভিটি ছিল। সেখানে বাংলাদেশী হোটেলও রয়েছে। ভারতে যাতায়াত কমে যাওয়ায়—বিশেষ করে চিকিৎসার জন্য—এখন লোকজন কুনমিং যাচ্ছেন। পর্যটন ও কেনাকাটার জন্যও আগে মানুষ ভারতে যেত। যাতায়াত সীমিত হওয়ায় এখন কুনমিং একটি পছন্দের গন্তব্য। এছাড়া সিঙ্গাপুর, ব্যাংকেকও যাচ্ছে লোকজন।

কুনমিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ সহজ বিধায় পারস্পরিক যোগাযোগটাও বাড়ছে। বিমানে মাত্র ২ ঘণ্টা সময় লাগে, দিল্লিতে যেতেও প্রায় একই সময় লাগে। বাংলাদেশ চায়না ভারত মিয়ানমার (বিসিআইএম) ইকোনমিক করিডোর ধারণার সূচনালগ্ন হলো ১৯৯৯ সালে কুনমিং ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে। আগে থেকেই বাংলাদেশের জন্য একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, কারণ পণ্ডিত মহল ও সাধারণ মানুষের যাতায়াত হতো। গত এক বছরে নতুন পরিস্থিতির কারণে এ যাতায়াত ও মিথস্ক্রিয়ার গতি ও ব্যাপ্তি আরো বেড়েছে।’

চলতি বছরের ১৯ জুন কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় চীন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রথম ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠক। কুনমিংয়ে ষষ্ঠ চীন-দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা বৈঠকের ফাঁকে এ ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান আঞ্চলিক শান্তি, উন্নতি ও স্থিতিশীলতার দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সম্ভাব্য ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে কুনমিং বাংলাদেশের জন্য দ্রুত উত্থানশীল একটি কেন্দ্র। প্রতি বছর এখানে আয়োজিত চায়না-দক্ষিণ এশিয়া এক্সপো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি বড় বাণিজ্য মঞ্চ। ব্যবসায়ীরা এখানে অংশ নিয়ে সরাসরি চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন। ২০২৫ সালের এক্সপোতে বাংলাদেশসহ অংশগ্রহণকারী দেশগুলো মোট ১৬৩টি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার আর্থিক পরিমাণ কয়েকশ কোটি ইউয়ান। একই সঙ্গে চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে অবকাঠামো, শিল্পাঞ্চল ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের সুযোগও তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কুনমিং বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে—এটাই স্বাভাবিক। ভৌগোলিকভাবে এটি বাংলাদেশের নিকটতম চীনা শহর, যার ফলে যোগাযোগ ও বাণিজ্যে বাড়তি সুবিধা পাওয়া সম্ভব। বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যসেবা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আর কুনমিংয়ে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল রয়েছে, যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন।’

বিভিন্ন নীতিগত বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আঞ্চলিক স্তরে যেসব আলোচনা হয়, তার অনেকটাই কুনমিং থেকে হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য কুনমিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দুই দিক থেকেই। বাংলাদেশে এর আগে যেসব চীনা কূটনীতিক কাজ করেছেন তাদের অধিকাংশই কুনমিংয়ের। বাংলাদেশের মানুষ, অর্থনীতি ও সামগ্রিক বিষয়ে তারা গভীর জ্ঞান রাখেন।’

বাণিজ্যের পাশাপাশি প্রযুক্তি ও অবকাঠামো সহযোগিতায় কুনমিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাড়ছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় ইউনান প্রদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

গত মার্চে চীন সফরে যান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সফরকালে তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় কুনমিংকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সমুদ্র ও স্থলবন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য বহুমুখী পরিবহন সংযোগ স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।

এছাড়া কুনমিংয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ জোরদার করতে চীনের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে ঢাকা-কুনমিং রুটে ফ্লাইট চালুর অনুমতি দিয়েছে। ফ্লাইট চালু হলে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের ভ্রমণ আরো সহজ হবে বলে আশা করছে চীন দূতাবাস, যা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও মানবসম্পর্ক বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

সব মিলিয়ে কুনমিং বাংলাদেশের জন্য একটি বহুমাত্রিক কৌশলগত বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। যা একদিকে আঞ্চলিক কূটনীতিতে নতুন সুযোগ এনে দিচ্ছে, অন্যদিকে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও স্বাস্থ্য খাতে কার্যকর সহযোগিতার পথ খুলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. সামসাদ মর্তুজা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কুনমিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা পুরো ইকোসিস্টেমের ব্যাপার আছে। সেখানে একজন ট্রান্সলেটর দরকার হয়, অ্যাকোমোডেশন দরকার হয়, খাবারের জায়গার দরকার। কারণ আমরা চীনা খাবারে অভ্যস্ত নই। ফলে শুধু স্বাস্থ্য না, কুনমিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপ্তি আরো বড়। এমনিতেও চীনের চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত।

কালচারাল মেমোরিতেও কুনমিংয়ের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। আমাদের মধ্যকার সভ্যতাগত যে যোগাযোগ, সেটা চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে সংযোগের মাধ্যমে আরো বড় হতে পারে। যখন কালচারাল শোকেসিং হয় তখন শুধু বিনোদনের বিষয়টিই মুখ্য থাকে। কিন্তু যখন প্রকৃত সেবা পাওয়া যায় তখন এর প্রভাব অন্য মাত্রার হয়ে ওঠে। পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশে চীনের হাসপাতালও গড়ে উঠতে পারে। সব মিলিয়ে আমার মনে হয়, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো খুবই ইতিবাচক।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়