ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক উত্তেজনা, সংঘাতের আশঙ্কা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চরম দুর্যোগের পটভূমিতে যুক্তরাজ্য সরকার তার নাগরিকদের জন্য এক নজিরবিহীন সতর্কতামূলক প্রচারণা শুরু করেছে। সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভয়াবহ মহামারি, দেশব্যাপী ইন্টারনেট বিপর্যয় বা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মতো জাতীয় সংকট মোকাবিলায় জনগণকে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। সরকারের নতুন এই নিরাপত্তা কৌশলের মূলে রয়েছে নাগরিকদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা, যাতে যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের এবং পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে।
মূল সতর্কতা: একটি রেডিও
সরকারের এই প্রস্তুতির আহ্বানের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি অত্যন্ত সাধারণ কিন্তু সংকটকালে অপরিহার্য যন্ত্র—রেডিও। নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রতিটি পরিবারকে কমপক্ষে একটি ব্যাটারিচালিত অথবা হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে চালানো যায় (Wind-up) এমন রেডিও কিনে রাখার জন্য বিশেষভাবে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কেন রেডিও?: সরকারের মতে, বড় ধরনের জাতীয় বিপর্যয়ে যখন বিদ্যুৎ সরবরাহ полностью বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে এবং ইন্টারনেট পরিষেবা অচল হয়ে পড়তে পারে, তখন জরুরি বার্তা, নির্দেশনা এবং খবর পাওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হবে রেডিও।
খরচ: এই ধরনের একটি রেডিওর দাম মাত্র ৫ পাউন্ড বা তার কাছাকাছি, যা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই।
গাড়ির রেডিওর বিকল্প?: যদিও গাড়িতে রেডিও থাকে, সংকটময় পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার জন্য ঘরে অবস্থান করাই শ্রেয়। তাই বাড়িতে একটি পোর্টেবল রেডিও থাকাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
‘প্রিপেয়ার’ ওয়েবসাইট ও জরুরি সামগ্রীর তালিকা
ব্রিটিশ সরকার ‘প্রিপেয়ার’ (Prepare) নামে একটি বিশেষ ওয়েবসাইট চালু করেছে, যেখানে জাতীয় সংকট মোকাবিলায় নাগরিকদের করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই ওয়েবসাইটে জরুরি পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য একটি ‘সারভাইভাল কিট’ বা জরুরি সামগ্রীর তালিকা মজুত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তালিকায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো হলো:
বিশুদ্ধ পানি: প্রতি সদস্যের জন্য প্রতিদিন অন্তত ৩ লিটার বোতলজাত বিশুদ্ধ পানি।
সংরক্ষিত খাবার: টিনজাত খাবার, শুকনো ফল বা সহজে নষ্ট হয় না এমন খাবার, যা রান্না ছাড়াই খাওয়া সম্ভব। সঙ্গে একটি ক্যান ওপেনার।
আলোর উৎস: ব্যাটারিচালিত টর্চ বা লণ্ঠন এবং অতিরিক্ত ব্যাটারি।
পাওয়ার ব্যাংক: মোবাইল ফোন ও অন্যান্য জরুরি ডিভাইস চার্জ দেওয়ার জন্য একটি সম্পূর্ণ চার্জ দেওয়া পোর্টেবল পাওয়ার ব্যাংক।
প্রাথমিক চিকিৎসা: একটি ফার্স্ট এইড কিট, যেখানে ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক, প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র থাকবে।
বিশেষ সামগ্রী: শিশুখাদ্য, ডায়াপার এবং পরিবারের বয়স্ক বা অসুস্থ সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ সামগ্রী।
‘গ্র্যাব ব্যাগ’ এর ধারণা
সরকার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছে, আর তা হলো একটি ‘গ্র্যাব ব্যাগ’ (Grab Bag) প্রস্তুত রাখা। এটি হলো একটি সহজে বহনযোগ্য ব্যাগ, যেখানে জরুরি পরিস্থিতিতে বাড়ি ছাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র আগে থেকেই গুছিয়ে রাখা থাকবে। যেমন—গুরুত্বপূর্ণ নথি (পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র), ঔষধ, শুকনো খাবার, পানি, টর্চ এবং একটি রেডিও। এর উদ্দেশ্য হলো, আকস্মিক evacuations বা স্থানান্তরের নির্দেশে তাড়াহুড়োর মধ্যে যেন কোনো অত্যাবশ্যকীয় জিনিস ভুলে ফেলে যেতে না হয়।
সরকারের উদ্দেশ্য ও বার্তা
যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো নয়। বরং, পরিবর্তিত বৈশ্বিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে নাগরিকদের আরও সচেতন ও সহনশীল করে তোলাই মূল লক্ষ্য। তাদের নিরাপত্তা কৌশলে বলা হয়েছে, "আমরা এমন এক সময়ের মুখোমুখি হয়েছি, যেখানে আমাদের নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ জানানো শক্তির সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।"
এই প্রস্তুতির মাধ্যমে সরকার নিশ্চিত করতে চায় যে, জাতীয় সংকটকালে জনগণ যেন সরকারি সাহায্যের জন্য অপেক্ষা না করে প্রাথমিক পর্যায়ে নিজেদের সুরক্ষা নিজেরাই নিশ্চিত করতে পারে। এর ফলে জরুরি পরিষেবা সংস্থাগুলোর ওপর চাপ কমবে এবং তারা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে মনোনিবেশ করতে পারবে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিক টাইমস, ব্রিটিশ সরকারের ‘প্রিপেয়ার’ ওয়েবসাইট (gov.uk/prepare)