আমীন আল রশীদ: পোশাক নিয়ে হাইকোর্টের একটি সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণÑ যেটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ আদালত সম্পর্কে অসম্মানজনক শব্দও প্রয়োগ করছেন। যদিও আদালত পোশাক সম্পর্কে কোনো রায় দেননি। আদালত বলেননি যে নারীরা এ ধরনের পোশাক পরবেন বা পরবেন না। এই আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার যে আদালতের নেই, সেটি বিচারপতিরাও জানেন। তারা মূলত পোশাক নিয়ে নিজেদের মন্তব্য করেছেন; আদালতের ভাষায় যেটিকে বলা হয় পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ রায় মানা যেরকম বাধ্যতামূলক, পর্যবেক্ষণ মানা সেরকম বাধ্যতামূলক নয়। গণমাধ্যমের খবর বলছে, পোশাকের জন্য নরসিংদী রেলস্টেশনে তরুণীকে হেনস্তার অভিযোগে করা মামলায় মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) এক আসামির জামিন আবেদনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে হাইকোর্ট প্রশ্ন রাখেন: ‘সভ্য দেশে এমন পোশাক পরে রেলস্টেশনে যাওয়া যায় কি না? ওই তরুণী প্ল্যাটফর্মে আপত্তিকর অবস্থায় ছিল, সিডিতে দেখা যায়। এটি আপনার অধিকার? পোশাকের অধিকার?’
দেখা যাচ্ছে, আদালত এখানে কিছু প্রশ্ন করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে। আদালত কোনো রায় দেননি। পোশাক সম্পর্কে আদালত যা বলেছেন, যেসব প্রশ্ন করেছেন, সেই প্রশ্ন দেশের অনেক মানুষের মনেও আছে ধরে নিচ্ছি। সংবিধান স্বাধীনতাকে অ্যাবসলিউট করেনি। অর্থাৎ যা খুশি করা বা বলার নাম স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা চিরকালই শর্তসাপেক্ষ। স্বাধীনতা শর্তসাপেক্ষ না হলে সমাজ ও রাষ্ট্রে নৈরাজ্য তৈরি হয়। মানুষ যদি যা খুশি বলা, লেখা ও করার স্বাধীনতা পায়, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা রাষ্ট্রও সামাল দিতে পারবে না। যে কারণে বাংলাদেশের সংবিধানেও স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে’ এবং ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে’ কথাগুলো স্পষ্টত উল্লেখ করা আছে।
প্রতিটি মানুষের একটি ব্যক্তিগত জীবন যেমন আছে, তেমনি আছে তার পারিবারিক ও সামাজিক জীবন। একই মানুষ একান্ত ব্যক্তিগত পরিবেশে যে পোশাক পরে থাকতে পারেন, সেই মানুষটিই পারিবারিক পরিবেশে ওই পোশাকে থাকেন না। তিনিই আবার রাস্তায় বের হলে, অর্থাৎ সামাজিক পরিবেশে অন্য পোশাকে বের হনÑএটাই স্বাভাবিক। আপনি যে পোশাক পরে ঘুমান, যে পোশাক পরে সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়ান, সেই পোশাক পরে নিশ্চয়ই পাবলিক প্লেসে যাবেন না। যদি যেকোনো পোশাক পরে যেকোনো জায়গায় ঘুরে বেড়ানোকে আপনার কাছে স্বাধীনতা মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে আপনার কাছে স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে যা খুশি করা; নৈরাজ্য।
পোশাক ব্যক্তির অভিরুচি ও পছন্দের বিষয়Ñএটা যেমন ঠিক, তেমনি আপনি কোন সমাজে, কোন ধরনের সাংস্কৃতিক আবহে বসবাস করছেন; আপনার রাষ্ট্রকাঠামোটি কেমন, সেটি বিবেচনায় নিয়েই পোশাক নির্বাচন করতে হয়। এটিই ভেবে দেখতে হয়। ইউরোপ-আমেরিকা এমনকি ভারত ও থাইল্যান্ডের সমুদ্রসৈকতেও বিকিনি পরে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকতে কোনো নারী বিকিনি পরে ঘুরে বেড়ালে সেটি দেশের প্রচলিত আইনে অপরাধ না হলেও বিদ্যমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোথায় কোন কথাটি বলা যায়, কোথায় কোন পোশাকটি পরা যায়, সেই বোধটুকু থাকাই নাগরিক ভব্যতা। আদালত মূলত সেটিই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এটি হচ্ছে মুদ্রার একপিঠ। এবার অন্য পিঠ নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ধরা যাক কোনো নারী রেলস্টেশনে, লঞ্চঘাটে কিংবা বাস টার্মিনাল অথবা বিমানবন্দরে এমন কোনো পোশাক পরে গেলেন, যেটি অন্য আরেকজন নারীর কিংবা পুরুষের চোখে দৃষ্টিকটু অথবা তার কাছে মনে হলো পোশাকটি অশ্লীল—তখন তিনি কি ওই সংক্ষিপ্ত পোশাক পরা নারীকে হেনস্তা করবেন বা লোক জড়ো করে তার উপর আক্রমণ করবেন? এই স্বাধীনতা কি দেশের সংবিধান বা কোনো আইন তাকে দিয়েছে? দেয়নি। তাহলে যদি কোনো নাগরিকের মনে হয় যে একজন নারী যে পোশাক পরে তার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন, সেটি অশ্লীল বা আপত্তিকর, তখন তিনি কী করবেন? চুপ থাকবেন নাকি তাকে শাসন করবেন? ঘটনা যাই হোক না কেন, নরসিংদী রেলস্টেশনে যারা পোশাকের কারণে ওই নারীকে হেনস্তা করেছেন, এটিও অপরাধ। কারণ রাষ্ট্র এই পুলিশিং করার অধিকার তাদের দেয়নি।
মুশকিল হলো, দেশের নাগরিকের একটি পক্ষ মনে করে, নারী যেকোনো পোশাকে যেকোনো জায়গায় ঘুরে বেড়াবে—এটিই তার স্বাধীনতা ও অধিকার। আরেকটি পক্ষ মনে করে, নারী মানেই তাকে কথিত শালীন পোশাক পরে, শরীর ঠিকঠাকমতো ঢেকে রাস্তায় বের হতে হবে। এই দুটি পক্ষই কট্টর। বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহ এর কোনোটিই সমর্থন করে না। ফেসবুক থেকে
লেখক: সাংবাদিক।