নভেম্বর, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে উত্তাল ও রক্তাক্ত ঘটনার মাস। ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার তিন মাসের মাথায় দেশ আরেক অস্থিরতার মুখে পড়ে। বিশেষ করে ৩ নভেম্বর। দিনের শুরুতে কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার নির্দেশে নিজ বাড়িতে আটকে রাখা হয় তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে। আর রাতে ঘটে জেলহত্যার ঘটনা। ইতিহাসের বেদনাবিধুর ও কালিমালিপ্ত সেই দিনের ৫০ বছর আজ। নিজের লেখা বইয়ে সে সময়ের ঘটনা ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (বীরবিক্রম)। বই থেকে চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
জিয়ার বন্দিত্ব
এরই মধ্যে চলে এলো ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর। আমি তখনও অসুস্থ এবং লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করি। বাসায় আমার স্ত্রী ও দুই মাসের কন্যাসন্তান। ভোর সাড়ে চারটা হবে তখন হঠাৎ আমার বাসার টেলিফোন বেজে ওঠে এবং অন্য প্রান্ত থেকে একজন মহিলা বলে ওঠেন, ‘ভাই, এখানে কী হচ্ছে? অফিসার ও সৈনিকরা আমার বেডরুম থেকে ‘‘ওকে’’ ধরে নিয়ে যাচ্ছে।’ এ বলেই তিনি ফোন রেখে দেন। আমি ঘুমের ঘোরে পুরো ব্যাপারটি আঁচ করতে পারিনি এবং বুঝতেও পারিনি তিনি কী বলতে চাচ্ছেন। এক পর্যায়ে ভাবলাম, হয়তো বেগম রওশন এরশাদ, যিনি একাকী আর্মি হেডকোয়ার্টারের অফিসার মেসের পাশে থাকতেন, তিনিই হয়তো টেলিফোন করে থাকবেন কোনো ভীতির কারণে। কেননা তখন পর্যন্ত মেজর জেনারেল এরশাদ সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে ছিলেন। ঠিক ওই মুহূর্তে আবার টেলিফোন বেজে ওঠে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো ‘ভাই, জিয়াকে বেডরুম থেকে ধরে নিয়ে ড্রইংরুমে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।’ আমি তৎক্ষণাৎ সম্বিৎ ফিরে পাই এবং অপর প্রান্তে বেগম খালেদা জিয়াকে বলি যে, ‘আমি আপনার বাড়িতে আসতে চেষ্টা করবো।’ এ বলেই আমি ফোন রেখে দিলাম।
আমি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে সামরিক পোশাক পরে বাইরে আসি। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে আমি ২য় ইস্ট বেঙ্গলের ১৫ জন বিশ্বস্ত নন-কমিশন্ড অফিসার ও সৈনিককে আমার বাড়ির পাহারায় নিয়োজিত করি। ১৯৬৪ সালে এই ২য় ইস্ট বেঙ্গলেই আমার সামরিক জীবনের শুরু। তারপর স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং পরেও আমি এই ২য় বেঙ্গলেরই অধিনায়ক ছিলাম। বাইরে এসে আমার গার্ড কমান্ডার হাবিলদার জাকিরকে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে সে আমাকে বিস্তারিত জানায়। হাবিলদার জাকির পুরো ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছে। সেনাপ্রধানের বাড়ি পাহারায় নিযুক্ত ছিল ১ম বেঙ্গলের সৈনিকেরা। আর ওই ইউনিটেরই অফিসাররা তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করেছে। সেনাপ্রধান জিয়াকে বাড়ির ভিতরে বন্দি করে রাখা হয়েছে বলে জাকিরকে তাঁর (জিয়ার) নিরাপত্তায় নিয়োজিত লোকজন জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সে আমাকে সেনাপ্রধানের বাড়িতে একাকী প্রবেশ করতে নিষেধ করে এবং প্রয়োজনে যেন তাদের নিয়েই প্রবেশ করি এমন অনুরোধ করে। আমি তাকে বলি, আমি একাই যাবো এবং তারা যেন আমার বাড়ির ছাদ ও অন্যান্য স্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করে।
ভোরের আলো তখন ফুটছিল। আমি লাঠিতে ভর করে সেনাপ্রধানের বাড়িতে প্রবেশ করি। হাবিলদার জাকির আমার সঙ্গে গেট পর্যন্ত এসে আমার বাড়িতে ফেরত যায়। আমি সেনাপ্রধানের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন তাজ (বর্তমানে আওয়ামী লীগের এমপি) স্টেনগান হাতে পায়চারি করছে। আমাকে দেখে সে সেখান থেকে সরে যায়। বাড়ির গেটে তালা ঝুলানো ছিল এবং ১ম ইস্ট বেঙ্গলের একজন জেসিও দাঁড়িয়ে ছিল। এ ছাড়া সেনাপ্রধানের এডিসি ক্যাপ্টেন জিল্লুর (পরে ব্রিগেডিয়ার অব.) বেসামরিক পোশাক পরে বাইরের গার্ডরুমে বসে আছে। উল্লেখ্য, ক্যাপ্টেন তাজ, উক্ত জেসিও এবং ক্যাপ্টেন জিল্লুর এরা সবাই আমার অধীনে ছিল। এ ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে আমি এদের ব্রিগেড অধিনায়ক ছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে তারা সবাই আমাকে চেনে। আমি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে জেসিওকে গেট খুলতে আদেশ করি। সঙ্গে সঙ্গে সে গার্ডরুম থেকে চাবি এনে গেট খুলে দেয়। আমি বাড়িতে প্রবেশ করি এবং ঘরে ঢুকেই দেখি বামদিকে সেনাপ্রধানের বসার ঘরে ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লা (বর্তমানে ব্যবসায়ী) খুব সতর্কভাবে স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে জেনারেল জিয়া ইউনিফর্ম পরে স্থির হয়ে সোফায় বসা। আমাকে বাসার ভেতরে দেখে হাফিজউল্লাহ আঁতকে ওঠে এবং জেনারেল জিয়াও হতভম্ব হয়ে যান। আমি কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে জিয়ার শোবার ঘরে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি খালেদা জিয়া তাঁর দুই ছেলে পিনো (তারেক) ও কোকোকে (আরাফাত) নিয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখে তিনি অবাক হন। ফোন করলেও তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, এরকম পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি হয়তো তাঁর বাড়িতে যাব না। যাহোক আমি তাঁকে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর জন্য রেডি করতে অনুরোধ করি এবং বেডরুম থেকে চলে আসি। আমার উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমেই জিয়ার দুই ছেলেকে বাড়ি থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেওয়া। আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল, প্রহরীরা আমার এই কাজে বাধা দেয় কি না তা যাচাই করা।
ড্রইংরুমে এসে ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাকে একইভাবে দেখি এবং রাগান্বিত স্বরে বলি সে যেন ড্রইংরুম থেকে সরে গিয়ে দাঁড়ায়। আমার আদেশ অনুযায়ী সে ড্রইংরুম থেকে চলে যায়। এরপর আমি জেনারেল জিয়ার পাশে গিয়ে বসি। জেনারেল জিয়া আমার কাছে জানতে চাইলেন, কর্নেল শাফায়াত জামিল কোথায়? আমি কথা বলতে চাই। আমি তাঁকে বলি, কর্নেল শাফায়াত জামিলের আদেশেই তিনি এখন বন্দি এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলে কী লাভ হবে। আমি প্রায় মিনিট দশেক তাঁর সঙ্গে আলাপ করি। এ পরিস্থিতিতে তাঁকে ধৈর্য্য ধরে এখানে থাকার জন্য বলি।
তিনি কর্নেল শাফায়াতকে ডেকে আনতে বললেন। আমি তাঁকে বললাম, আমি তো পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে জানি না। আপনার স্ত্রীর ফোন পেয়ে আমি সোজা আপনার বাসায় চলে এসেছি। তবে বাসায় ঢোকার সময় যা দেখলাম তাতে মনে হলো, কর্নেল শাফায়াতের ব্রিগেডের (৪৬ ব্রিগেড) অফিসার ও সৈন্যরা আপনাকে গৃহবন্দি করেছে। আপনি নিজেও ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন।
তিনি আমার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন যার অর্থ হলো, এ পরিস্থিতিতে আমি কীভাবে তাঁর বাড়িতে ঢুকলাম। আমি তাঁকে বললাম, আপনার ছেলেদের বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। তিনি বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এ সময় খালেদা জিয়া তাঁর ছেলেদের নিয়ে ডাইনিংরুমে আসেন। আমি তাঁদের নাশতা করতে বললাম এবং নাশতা শেষ হলে ড্রাইভারকে ডেকে তাদের স্কুলে নিয়ে যেতে বললাম। এ সময় আমাকে কেউ কোনো বাধা দেয়নি।
জিয়া আমাকে বললেন, তুমি কি একা এসেছো? আমি উত্তরে বললাম, হ্যাঁ। যদিও তিনি বেশ শান্ত ও ধীরস্থির ছিলেন, তবু তাঁর বাড়িতে আমার তৎপরতা দেখে তিনি বিস্মিত হন। এরপর আমি বাইরে চলে আসি। এ সময় জিয়াকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়েছিল।
ঘরের বাইরে এসে দেখি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেখানে এসে উপস্থিত। সম্ভবত ক্যাপ্টেন তাজ আমাকে সেনাপ্রধানের বাড়িতে অনায়াসে প্রবেশ করতে দেখেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে অবহিত করেন। তিনি প্রথমে আমার পায়ের ক্ষত এবং অসুস্থতার খোঁজখবর নেন। তারপর বলেন, চেইন অব কমান্ড ঠিক করার জন্য এই অভ্যুত্থান জরুরি ছিল। আকাশে তখন মিগ ও হেলিকপ্টার উড়ছিল এবং সেদিকে তাকিয়ে খালেদ মোশাররফ আমাকে বললেন, চেইন অব কমান্ড ঠিক না করলে দেশ ও সেনাবাহিনী শেষ হয়ে যাবে, তাই এ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছি। আমি তখন উল্টো প্রশ্ন করলাম, চেইন অব কমান্ড ভেঙে সেনাপ্রধানকে বন্দি করে কি চেইন অব কমান্ড ঠিক করা যায়? তিনি উত্তরে কিছুই বললেন না।
আমরা দুজনেই সেনাসদরে পিএসও (প্রধান উপদেষ্টা)- তিনি সিজিএস আর আমি এজি। খালেদ মোশাররফ আমার এক র্যাংক সিনিয়র হলেও অ্যাপয়েন্টমেন্টের (পিএসও) দিক থেকে দুজনেই একই পর্যায়ের। জেসিও এবং অন্য সৈনিকগণ সেনাপ্রধান জিয়ার বাড়ির ভিতরে আমার কার্যকলাপে কোনো বাধা না দেওয়ায় তিনি চিন্তিত ছিলেন, যদিও তাদের ওপর নির্দেশ ছিল কাউকে ভিতরে প্রবেশ করতে অথবা বাড়ি থেকে বাইরে যেতে না দেবার। কিন্তু তারা নির্বিবাদে আমার আদেশ পালন করেছে। এতে একটি বিষয় আমার কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সেনাপ্রধানের বাড়িতে নিয়োজিত এসব সৈনিক মনেপ্রাণে সেনাপ্রধানকে বন্দি করার পক্ষে ছিল না।
আমি সেনাপ্রধানের বাড়ি থেকে ধীরে ধীরে হেঁটে আমার নিজের বাড়িতে ফিরে আসি। এসে দেখি আমার বাড়ির সামরিক ও বেসামরিক টেলিফোন দুটোরই সংযোগ বিচ্ছিন্ন। এ হাঁটাচলায় আমার পায়ের ক্ষতে ব্যথা হচ্ছিল। একজন প্রহরীকে পাঠিয়ে গাড়ি আনি। প্রহরীরা আমাকে জানায়, তারা খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে যে, অভ্যুত্থানকারীরা আমার বাড়ির সন্নিকটে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সমবেত হয়েছেন। আমি নাশতা সেরে ওইদিকে রওনা দিলাম। প্রহরীদের সতর্ক থাকতে বললাম। আমার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় প্রহরীরা উত্তেজিত ছিল। তাদের আমি সান্ত্বনা দিই। আমার ভয় ছিল তারা যে কোনো সময়ে যে কোনো অঘটন ঘটাতে পারে। কারণ তারাও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত ছিল।
৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলে অভ্যুত্থানকারীদের তৎপরতা
আমি সেখানে গিয়ে দেখি, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেনাসদরের ও ৪৬ ব্রিগেডের বেশ কয়েকজন অফিসার বাইরে দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে। তারা আলোচনায় রত। আমি পৌছার সঙ্গে সঙ্গে লে. কর্নেল মালেক (পরে ঢাকার মেয়র এবং জাতীয় পার্টি হয়ে বর্তমানে আওয়ামী লীগার) আমার কাছে এসে বললেন, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তাঁকে বলেছেন আমাকে জানানোর জন্য যে, আজ ভোরে সেনাপ্রধান জিয়ার সঙ্গে আমার যা যা আলাপ হয়েছে তা যেন কাউকে না বলি। আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলি, তিনি যেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে অবহিত করেন, আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের কোনো আদেশ বা উপদেশ নিতে প্রস্তুত নই। তাঁকে আরো বললাম, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এখনও সেনাপ্রধান নন। আর যদি হয়েও থাকেন তাও আমার জানা নেই। এর একটু পরেই আমি ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসে অনাহুতের মতো প্রবেশ করি। সেখানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়াত, মেজর হাফিজ, মেজর গাফ্ফার ও অন্যান্য অফিসার যাঁরা এ অভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের বিভিন্ন আলাপচারিতায় দেখি। আমি একটি চেয়ার নিয়ে নিজেও বসে পড়ি। তখন সেখানে নানাবিধ আলোচনা চলছিল। বিভিন্ন স্থানে টেলিফোন করা হচ্ছে এবং সবাই উত্তেজিত।
কিছুক্ষণ পর বঙ্গভবন থেকে মেজর শরীফুল হক (ডালিম), মেজর নুর দুজন এসে উপস্থিত হলো। তাদের উপস্থিতি দেখে আমি অবাক হলাম। পরে বুঝতে পারলাম, তারা মেজর রশিদ-ফারুকের বার্তা নিয়ে এখানে এসেছে দুপক্ষের মধ্যে এ বিরোধের একটা সন্তোষজনক মীমাংসার জন্য, যাতে করে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো যায়। আলোচনায় বুঝতে পারলাম, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল মেজর ফারুক, রশিদ ও তাদের সহযোগীদের বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ চায়। এ বার্তা নিয়ে মেজর নুর ও শরীফুল হক (ডালিম) বঙ্গভবনে রওয়ানা হয়। তাদের বলা হয়েছে, এই বার্তা রাষ্ট্রপতি মোশতাক, মেজর রশিদ ও ফারুককে দেওয়ার জন্য এবং এর উত্তর সত্বর যেন দেওয়া হয়। তারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। এরই মধ্যে জেনারেল ওসমানী বঙ্গভবন থেকে ফোন করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি হুঁশিয়ার করে দেন যেন কেউ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়। কারণ এ পরিস্থিতিতে দেশে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তাঁকে উত্তরে জানান, যদিও তিনি বর্তমানে সেনাপ্রধান নন তবুও একটা মীমাংসার চেষ্টা করবেন। তিনি মেজর ফারুক-রশিদকে বুঝিয়ে আত্মসমর্পণ করানোর জন্য ওসমানীকে অনুরোধ করেন।
এর মধ্যে নানারকম হৈচৈ হচ্ছিল। যাহোক, শেষ পর্যন্ত ঠিক করা হলো মেজর জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করানো হবে এবং জেনারেল ওসমানী ও রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে জানানো হবে, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে যেন সত্বর সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার কাছ থেকে ইস্তফাপত্র নেওয়ার জন্য কে সেখানে যাবেন তা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছিল এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছিলেন না। এসব দেখে আমার বেশ কৌতূহল হলো। কারণ এসব আলোচনায় অভ্যুত্থানকারীরা বেশ সময় নষ্ট করছেন। এ থেকে বোঝা যায়, এ অভ্যুত্থানের কোনো বিশেষ পরিকল্পনা তাদের ছিল না এবং নেতৃত্বের সমস্যা ছিল। তাদের উদ্দেশ্য তাদের কাছেই পরিষ্কার ছিল না।
জিয়ার ইস্তফা আদায়
শেষ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার রউফ (যিনি ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ডিজিএফআই প্রধান ছিলেন এবং বর্তমানে প্রয়াত) ও লে. কর্নেল আনোয়ার (পরে মেজর জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে ডিজি, এনএসআই এবং রাষ্ট্রদূত অব.) এ দুজনকে তাঁদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও জিয়ার বাড়িতে পাঠানো হলো ইস্তফাপত্রে স্বাক্ষর আনার জন্য। তাঁরা সেনাপ্রধান জিয়ার বাড়িতে যান এবং ইস্তফাপত্রে স্বাক্ষর নিতে সক্ষম হন। এদিকে অনেক আলোচনার পর ঠিক করা হয়, মেজর রশিদ-ফারুকসহ অন্য যারা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল তারা রাতের বেলায় একটি বিশেষ বিমানযোগে তৃতীয় দেশের উদ্দেশে ব্যাংককের পথে ঢাকা ত্যাগ করবে।
বেলা বাড়ছিল। আমি সেখান থেকে আর্মি হেডকোয়ার্টারে আমার অফিসে চলে যাই। গিয়ে দেখি, অফিসে বিশেষ কোনো অফিসার নেই, শুধু সৈনিক ও স্টাফরা আছেন। আমার অফিসের টেলিফোন সংযোগও বিচ্ছিন্ন। আমি এতে অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে পাশের কক্ষ থেকে কর্নেল শাফায়াতের সঙ্গে কথা বলি। তাঁকে রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞাসা করি, এসব করা কি ঠিক হচ্ছে? আমার টেলিফোন সংযোগ কেন বিচ্ছিন্ন করা হলো? উত্তরে তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে আমাকে জানান। তাঁর কথা আমি অবশ্য বিশ্বাস করেছি এজন্য যে, এসব ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নির্দেশেই করা হয়েছিল।
আর্মি হেডকোয়ার্টারে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে আলাপ-আলোচনায় বুঝতে পারলাম জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার, নন-কমিশন্ড অফিসার ও সৈনিকগণ সেনাপ্রধান জিয়াকে বন্দি করার ঘোর বিরোধী ও মনঃক্ষুণ্ণ। এ অভ্যুত্থানে তাদের মোটেও সায় নেই। আমি দুপুরের দিকে বাড়িতে ফিরি। পথিমধ্যে কর্নেল শাফায়াতের সঙ্গে দেখা। আমি তাঁকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেসা করলাম, এ অভ্যুত্থানে কি বিভিন্ন পদবির সৈনিকগণের সমর্থন আছে? উত্তরে তিনি হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন। আমি আর কিছু না বলে বাড়িতে চলে গেলাম।
খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান
এদিকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ জেনারেল জিয়ার ইস্তফার কারণে নতুন সেনাপ্রধান হলেন। তিনি রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল হুদাকে (আগরতলা মামলার আসামি এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন) এবং কর্নেল নওয়াজীশের অধীন ১০ ইস্ট বেঙ্গল যা তাঁর অধীনে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে গঠিত হয়েছিল তাদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। কর্নেল হুদাকে ঢাকায় আনা হয়েছিল সম্ভবত আমার স্থলাভিষিক্ত করার জন্য। কারণ আমি এসব অনাকাঙ্ক্ষিত উচ্ছৃঙ্খল ঘটনার বিরোধিতা করে আসছি। তাই খালেদ মোশাররফ আমার কার্যকলাপে বেশ অস্বস্তিতে ছিলেন।
এদিকে ৪ তারিখ সকালবেলায় খবরে জানা যায়, ৩ তারিখ রাতেই জেলে আটককৃত সর্বজনাব নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান-এ চার নেতাকে রাষ্ট্রপতি মোশতাক, মেজর রশিদ ও ফারুকের আদেশে জেলের ভিতরেই নৃশংসভাবে ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাংক রেজিমেন্টের কজন সৈনিক হত্যা করে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, জেলখানায় সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডের খবর ৩০ ঘণ্টা পর বাইরের লোকজনের কাছে প্রকাশ পায়। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ও ফারুক-রশিদরা যখন ৩ তারিখের অভ্যুত্থানের খবর পায় এবং তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেয় তখনই এদের ধারণা জন্মে যে, এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেলে আটককৃত চার নেতাকে বের করে এনে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে সরিয়ে নতুন সরকার গঠনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলখানায় ওই জঘন্য নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে ও শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতি ঘটে।
নতুন সেনাপ্রধান হওয়ার পর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ৫ তারিখে আর্মি হেডকোয়ার্টারে আর্মির সিনিয়র অফিসারদের একটি সভা আহ্বান করেন। সভায় তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। মূলত কোনো সমস্যারই তিনি সঠিক সমাধান করতে পারছিলেন না। বলা যায়, তিনি সমস্যার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলেন। তাই আমার মনে হতে লাগলো, তাঁর এ সেনাপ্রধানের চাকুরি বোধ হয় খুবই ক্ষণস্থায়ী হবে। এর মধ্যে শহরে এবং সেনানিবাসে জোর গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে, খালেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগ ও ভারতের ইঙ্গিতে ও পরোক্ষ সহায়তায় ৩ তারিখের এ অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছেন। অর্থাৎ অভ্যুত্থানটি ভারতপন্থী। এর একটি সম্ভাব্য কারণ, আওয়ামী লীগ ৪ তারিখে এই অভ্যুত্থানের পক্ষে ঢাকায় একটি মিছিল বের করে যেখানে অন্যদের মধ্যে সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফের মা-ও অংশ নেন। এ ছাড়া মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ সম্পর্কে সেনানিবাসে রটনা ছিল যে, তিনি ভারতঘেঁষা।
এটা উল্লেখ করতে হয় যে, আমার জানামতে, এ অভ্যুত্থানে ভারতের কোনো ভূমিকা ছিল না। অভ্যুত্থানকারী অফিসারগণ মোটেই ভারতপন্থী ছিলেন না এবং এই অভ্যুত্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তাঁদের কোনো বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে অভ্যুত্থানকারী সিনিয়র অফিসারদের চিন্তাধারা সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলাম। এটা নিছক কাকতালীয় এবং সম্পূর্ণভাবে আর্মির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার ব্যাপার ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেনাবাহিনীতে ও দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে ধারণা জন্মে যে, এটা ছিল আওয়ামী লীগ ও ভারতের পক্ষে অভ্যুত্থান। আর এটাই পরে তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
বিচারপতি সায়েম নতুন রাষ্ট্রপতি
এদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় চার নেতাকে জেলখানায় বন্দি অবস্থায় হত্যার পর ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্রপতি মোশতাক এ ঘটনা চেপে রাখেন যতক্ষণ মেজর ফারুক-রশিদ ও তাদের সহযোগীরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশত্যাগ না করেন। ফলে যখন এ ঘটনা প্রকাশ পায়, তখন জনগণ ও আর্মি এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্রপতি মোশতাক ও মেজর ফারুক-রশিদকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করে। তাই এ ঘটনার পর খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ফলে অভ্যুত্থানকারী অফিসারগণ প্রধান বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তাঁদের অনুরোধের প্রেক্ষাপটে তিনি ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। সে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে আমিও আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলাম।
আমার মনে হচ্ছিল, সবকিছুই কেমন যেন ‘এডহক’ ভিত্তিতে হচ্ছিল। সবকিছুই ঘোলাটে মনে হচ্ছিল। তখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়নি। তিনি বঙ্গভবন আর সেনাসদরের মধ্যেই দেন-দরবারে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে বা সেনাবাহিনীর উদ্দেশে কোনো বক্তব্য প্রচার করেননি। অথচ অভ্যুত্থানের ৭২ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। ফলে অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য এবং অভ্যুত্থানকারীদের পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে কারোই পরিষ্কার ধারণা ছিল না। বিশেষ করে ভারতপন্থী বলে অভ্যুত্থান বিষয়ে যে গুজব ছড়িয়েছিল তার সঠিক কোনো প্রত্যুত্তর তার বা তাদের পক্ষ থেকে ছিল না। আর এই সুযোগে একের পর এক গুজব পুরো সেনানিবাসকে গ্রাস করে।
সূত্র: এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক। লেখক: মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) বীরবিক্রম