এল আর বাদল : ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক কার্যকর হয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপর আরোপিত শুল্ক বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন বেশ স্বস্তিতে। ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ বাংলাদেশকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক কার্যকর হয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপর আরোপিত শুল্ক বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন বেশ স্বস্তিতে। ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ বাংলাদেশকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ---- ডয়েচেভেলে
কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ৮০ ভাগই তৈরি পোশাক।
বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্কের পরিমাণ এখন ২০ শতাংশ। আগের ১৫ শতাংশ মিলিয়ে মোট ৩৫ শতাংশ। প্রথমে (২ এপ্রিল) অতিরিক্ত শুল্ক ধরা হয়েছিল ৩৭ শতাংশ।
পরে ৩৫ এবং সর্বশেষ আলোচনায় তা ২০ শতাংশে নেমে আসে।কিন্তু ভারতের ওপর এখন ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশ সুবিধাহনক অবস্থানে আছে। কারণ, বাংলাদেশ মূলত যুক্তরাষ্ট্রে টি-শার্টের মতো বেসিক গার্মেন্টস রপ্তানি করে। ভারতও তাই। ভারতের ওপর প্রথমে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলেও রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির ‘শাস্তি' দিতে আরো ২৫ শতাংশ বাড়িয়েছেন ট্রাম্প । ফলে, ভারতকে এখন ‘অতিরিক্ত' মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। পাকিস্তানের ওপর নতুন আরোপ করা শুল্ক ১৯ শতাংশ।
পাকিস্তানের এই সারিতে আরো আছে কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ও ফিলিপাইন্স। ২০ শতাংশে বাংলাদেশ ছাড়াও আছে শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম। ২৫ শতাংশে আছে ব্রুনাই, কাজাখাস্তান, মলদোভা ও টিউনিসিয়া। চীনের ওপর শুল্ক আরো বেশি হতে পারে।
প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ একই অবস্থানে আছে
ভারত ছাড়া বাংলাদেশের পোশাক খাতে আরো দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হলো, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া। তাদের আর বাংলাদেশের শুল্ক হার একই আছে। ফলে, প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ একই অবস্থানে আছে। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস)-এর গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন," বাংলাদেশ এখন দুইটি দিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বাংলাদেশ ও ভারত একই ধরনের পোশাক রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে।আর ভারতের ওপর এখন অতিরিক্ত শুল্ক ৫০ শতাংশ। এর ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রে বাড়বে। ভারতের অর্ডার বাংলাদেশে চলে আসবে। কারণ, ভারত থেকে পোশাক নিলে তার দাম বেশি পড়বে।আর বায়াররা বাংলাদেশ থেকে যে সুবিধা পায়, ভারত থেকে তা পায় না।”
"তবে বাংলাদেশে বেশি অর্ডার আসলে তা নেয়ার মতো প্রস্তুতি থাকতে হবে বাংলাদেশের। ২০১৪ সালেও বাংলাদেশে বাড়তি অর্ডার এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রস্তুতির অভাবে তা নিতে পারেনি। ওই অর্ডার তখন চলে যায় ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কায়। এবার যেন সেরকম না হয়,” বলেন তিনি।
তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক এবং ডেনিম এক্সপার্ট-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, "আসলে শুল্ক আরোপ করার প্রথম ঘোষণার পর বায়াররা থমকে গিয়েছিলেন। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তাই তারা তাদের অর্ডার স্থগিত করেছিলেন। কিন্তু এখন আবার সেই অর্ডার চালু হয়েছে।
আমরা এখন প্রতিযোতিায় একই অবস্থানে আছি এবং ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছি। কিন্তু এই অতিরিক্ত শুল্কের কারণে তো পোশাকের দাম বাড়বে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়তে শুরু করেছে। ফলে পোশাকের চাহিদা সেখানে প্রাথমিকভাবে কিছুটা হলেও কমছে।
তার কথা, এখন ক্রেতারা চাইছেন ভোক্তাদের ওপর বাড়তি দাম না চাপিয়ে কীভাবে বাজার ধরে রাখা যায়। ফলে, এখানে একটা বড় ধরনের দরকষাকষি শুরু হবে পোশাক শিল্প মালিকদের সাথে বায়ারদের। আমরা তো খরচ কমাতে পারবো না। তাই আমাদের ওপর যত শতাংশ শুল্ক চাপাবে, ততটুকু আমাদের মুনাফা কমবে। এখন সেটা কোথায় যায় তা দেখার আছে।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন," আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও ভিয়েতনাম। চীন আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। কারণ, আমরা যে ধরনের পোশাক তৈরি করি, তারা তা করে না। ভারতের শুল্ক এখন অনেক বেশি। ভিয়েতনামের আমাদের সমান। কিন্তু ভিয়েতনামের কিছু সমস্যা আছে। তারা অধিকাংশ কাঁচামাল আনে চীন থেকে।
সেখানে একটা বিধিনিষেধ থাকবে। ফলে আমাদের এখানে অর্ডার বাড়বে।” "কিন্তু আমরা ভালো অবস্থানে থাকবো কিনা তা নির্ভর করছে সরকারে সিদ্ধান্তের ওপর। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সুবিধা, ব্যাংক ঋণ। এগুলো না পেলে তো সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব হবে না, বলেন তিনি।
আমদানির পরিমাণ অনেক কম
চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে, সেই তুলনায় আমদানির পরিমাণ অনেক কম। ইউনাইটেড স্টেটস সেন্সাস ব্যুরো বলছে, জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ২০৩.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে এবং ফেব্রুয়ারিতে এনেছে মাত্র ৮৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে ওই দুই মাসে মোট ২৯০.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করতে পেরেছে।
সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসেই এই দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৭০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পাঠিয়েছে তৈরি পোশাক।
আর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি এনেছে সয়াবিন। গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
এই হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঘাটতির পরিমাণ ৬১৫ কোটি ডলার।
পাল্টা শুল্ক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় টার্গেট ছিল বণিজ্য ঘাটতি কমানো, তার দেশের পণ্য রপ্তানি বাড়ানো। যে ট্রান্সশিপমেন্ট শুল্কের কথা এখন আবার জানা যাচ্ছে, তা-ও আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাঁচামাল রপ্তানি বাড়ানোর জন্য। যুক্তরাষ্ট্র ফিনিশড প্রোডাক্ট এবং কাঁচামাল দুইটির রপ্তানিই বাড়াতে চায়। সেই কারণেই শুল্ক আলোচনায় ফল পেতে শেষ দফা আলোচনায় যাওয়ার আগে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২.২০ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির অনুমোদন দেয় ।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি নতুন বোয়িং বিমান আনারও চুক্তি করার কথা । এর আগে প্রতি বছর পাঁচ লাখ টন এলএনজি আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। এছাড়াও সয়াবিন ,তুলা, ডাল আমদানিরও নতুন চুক্তি হচ্ছে। আর স্টারলিংক বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। বাংলাদেশকে এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি আরো বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক ছাড়াও জুতা, টুপি, তাঁবু, ব্যাগ, আসবাব, খাদ্যপণ্য, হিমায়িত পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। গত অর্থবছরে ১৭৬টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রপ্তানির জন্য শতভাগ দেশটির ওপর নির্ভরশীল ছিল। মোট ৭০৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৫০ শতাংশের বেশি রপ্তানি করেছে, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩১৯টি।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের বাজারও বাড়ছে। আর বাংলাদেশি চামড়াজাত পণ্যেরও একক দেশ হিসাবে সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র।
গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মোট চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ২৩ শতাংশই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। ওই সময়ে মোট ২৮৯.৬ মিলিয়ন ডলারের চামড়াজাত পণ্য সেখানে গেছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, "শুধু তৈরি পোশাক নয়, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে আরো যেসব পণ্য যায়, নেগুলোও এখন প্রতিযোগিতায় একইভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাড়তি শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়বে।
বাংলাদেশের শিল্প উৎপাদনে, বিশেষ করে পোশাক শিল্পে অন্যদেশের তুলনায় শুধুমাত্র সস্তা শ্রম ছাড়া অন্য দক্ষতা কম। ফলে, দক্ষতা বাড়িয়ে দাম কম রাখার ব্যাপারে বাংলাদেশকে আরো অনেক কিছু করতে হবে।
আর বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে অতিরিক্ত শুল্ক আরো কমানো যায়।
কারণ, শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়বে। অথবা মুনাফা কমবে। আর ভারত যে বসে থাকবে, তা নয়। তারাও আলোচনা চালাবে শুল্ক কমাতে,” বলেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের যে শুল্ক-চুক্তি হয়েছে, তা এখানো প্রকাশ করা হয়নি।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বুধবার বলেছেন, "যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে 'নন-ডিসক্লোজার' শুল্ক চুক্তি হচ্ছে, তা এখনই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই চুক্তি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডাব্লিউটিও)-র মতো নয়, বরং একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। তাই এতে প্রতিযোগী দেশগুলোর কথা বিবেচনায় রাখতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, "চুক্তির খসড়া এখনো তৈরি হচ্ছে। শুল্কহার আরও কম হলে ভালো হতো, তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো।
শুল্কহার ২০ শতাংশ হওয়ার কথা থাকলেও চুক্তির পর কোথায় কী কমানো যায়, সেই বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।”
ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন," আসলে চুক্তির শর্তগুলো প্রকাশ হলে আরো বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সিদ্ধান্ত নেয়া আরো সহজ হবে। তবে আমাদের এই অবস্থা থেকে শিক্ষা নেয়ার দরকার আছে। আমাদের পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যের নতুন বাজার খুঁজতে হবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের পর অন্য দেশ এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে তখন আমরা কী করবো। সেজন্য আমাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। শুধু সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করলে চলবে না।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ ভাগই আসে তৈরি পোশাক থেকে। একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। গত বছর মোট রপ্তানি পোশাকের ১৮ শতাংশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে।