শিরোনাম
◈ জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন ◈ ইরানের ইস্পাহান ও তাব্রিজে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা, ৩টি ভূপাতিত (ভিডিও) ◈ জাতিসংঘে সদস্যপদ প্রস্তাবে মার্কিন ভেটোর নিন্দা ফিলিস্তিনের, লজ্জাজনক বলল তুরস্ক ◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংসদে আইন পাশ করব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক

প্রকাশিত : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ০৪:০৬ দুপুর
আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:৫২ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রহস্যের বেড়াজালে উদ্ধার হওয়া রহিমার নিখোঁজ!

রহিমা বেগম

আলামিন শিবলী : খুলনা মহেশ্বরপাশার নিখোঁজের ২৯ দিন পর আলোচিত রহিমা বেগমকে শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাতে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রাম থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কুদ্দুস মোল্যার পরিবারের ৩ সদস্যকে আটক করে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা ট্রিবিউন।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস বিশ্বাসের (৫৫) বাড়ি থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশ যখন কুদ্দুসের বাড়িতে পৌঁছায়, তখন রহিমা বেগম সেখানে ক্দ্দুসের স্ত্রী ও ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে গল্প, হাসি-আড্ডায় মেতে ছিলেন। কিন্তু পুলিশ দেখার পর থেকেই তিনি নির্বাক হয়ে যান। হেফাজতে নেওয়ার পর রাতেও আর কিছু খেতে চাননি। তিনি এখন ইশারায় কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। প্রশ্ন উঠেছে, রহিমার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা কি তাহলে নাটক?

বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রামের যার বাড়িতে রহিমা বেগম আত্মগোপনে ছিলেন সেই কুদ্দুস বিশ্বাসের ভাগনে জয়নাল বলেন, আমার মামা কুদ্দুস বিশ্বাস খুলনা শহরের মীরেরডাঙ্গা সোনালী জুট মিলে চাকরির সুবাদে রহিমা বেগমের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। আমি ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে রহিমা বেগমের মেয়ে মরিয়ম মান্নানের স্ট্যাটাস থেকে তার নিখোঁজের বিষয়টি জানতে পারি। তারপর ওই ছবিটি রহিমা বেগমকে দেখিয়ে বলি যে, এটা আপনার ছবি কিনা? ওই সময় রহিমা বলেন— আমার ছবির মতোই তো লাগতেছে। এমনকি মেয়ের ছবি দেখার পরও বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান বলেও জানান জয়নাল।

পরে মরিয়ম মান্নানের ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেওয়া দুটি মোবাইল ফোন নম্বরেও (০১৭৭১১০..০২, ০১৫৫৮৩৪..০৫) যোগাযোগ করেন জয়নাল। তিনি বলেন, ‘এর একটি নম্বরের কল রহিমা বেগমের ছেলে মিরাজের স্ত্রী রিসিভ করেন। রহিমার বিষয়টি তাকে বললে, তিনি ওই নম্বরে আর ফোন দিতে নিষেধ করেন। এরপর ফোন দিলেও আর ফোন রিসিভ করেননি। একজন ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তির সন্ধান দিয়ে ফোন করার পরও তার স্বজনদের এমন আচরণ অবাক করেছে জয়নালকে। সন্দিহান হয়ে তিনি রহিমা বেগমকে না জানিয়েই বিষয়টি শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোশাররফ হোসেনকে জানান। সেই ইউপি সদস্য খুলনা মহানগরের ২ নম্বরের ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন ‘নিখোঁজ হওয়া’ রহিমা বেগমই সেই নারী।

মোশারফ হোসেন আরও বলেন, খুলনা মহানগরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাইফুল ইসলাম আমার পূর্বপরিচিত। রহিমা বেগমকে না জানিয়ে আমরা কাউন্সিলর সাইফুলকে সবকিছু খুলে বলি। তারা খুব দ্রুত রহিমা বেগমকে নিয়ে যাবেন বলে জানান। রহিমা বেগম যেন সেখান থেকে পালিয়ে না যান, সে বিষয়েও আমাদের নজর রাখতে বলেন কাউন্সিলর। তারপর শনিবার রাতে খুলনা ও বোয়ালমারী থানা পুলিশের উপস্থিতিতে রহিমা বেগমকে খুলনা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে রহিমা নিখোঁজের ঘটনা ‘সাজানো নাটক’ বলে মনে করছেন এই জনপ্রতিনিধি।

এর আগে ময়মনসিংহের ফুলপুর থানা এলাকায় উদ্ধার হওয়া এক নারীর মরদেহ নিজের নিখোঁজ মা রহিমা বেগম বলে ২২ আগস্ট ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান। পরদিন ফুলপুর থানায় গিয়ে তিনি ছবি দেখে ও নিহতের পায়জামা দেখে ওই লাশ তার মায়ের বলে দাবি করেন মরিয়ম। তিনি লাশের ডিএনএ-এর সঙ্গে তার ডিএনএ মিলিয়ে দেখারও আবেদন করেন। এদিকে শনিবার রাতে মরিয়ম মান্নান ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, মাকে উদ্ধারের খবর পেয়েছি। আমার থেকে খুশি এই মুহূর্তে কেউ নেই। আমি এই মুহূর্তে খুলনা যাচ্ছি।

বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ আব্দুল ওহাব বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, খুলনা থেকে পুলিশের একটি দল এবং বোয়ালমারী থানা পুলিশ শনিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে তাকে উদ্ধার করে। রহিমা বেগমকে উদ্ধারের সময় কুদ্দুস বিশ্বাস বাড়িতে ছিলেন না। সে সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সেই বাড়ির তিন জনকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। তারা হলেন- বাড়ির মালিক কুদ্দুস বিশ্বাসের স্ত্রী হিরা বেগম (৫০), ছেলে আল আমিন বিশ্বাস (২৫) ও কুদ্দুস বিশ্বাসের ছোট ভাই আবুল কালামের স্ত্রী রাহেলা বেগম (৪৫)। তারা এখন খুলনা পুলিশের জিম্মায় রয়েছেন বলে জানা গেছে। কুদ্দুস বর্তমান বোয়ালমারী উপজেলা ডোবরা জনতা জুট মিলে কর্মরত। রহিমা বেগমকে উদ্ধার করে রাতেই খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি পরিবারের কারও সহায়তায় বোয়ালমারীতে আত্মগোপনে ছিলেন বলে ধারণা করছেন ওসি মুহাম্মদ আব্দুল ওহাবও। যদিও বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য খুলনা পুলিশ ভালো দিতে পারবে বলেও জানান তিনি।

খুলনা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি থেকে রহিমা বেগমকে উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি জানান, গোয়েন্দা তদন্তের ভিত্তিতে জানতে পারি নিখোঁজ রহিমা ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি অবস্থান করছেন, ওই তথ্যের ভিত্তিতে কেএমপির একটি টিম তাকে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে পৌঁছান এবং ওই বাড়ি থেকেই অক্ষত অবস্থায় রহিমাকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া বাড়িতে তিনি গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে অবস্থান করছিলে বলে জানিয়েছেন কুদ্দুসের স্বজনরা। এ ঘটনায় পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য উদ্ধার হওয়া বাড়ি থেকে একজন পুরুষ ও দুই মহিলাকে হেফাজতে নিয়েছে। তবে রহিমা কিভাবে নিখোঁজ হলেন কিংবা নিজেই আত্মগোপনে ছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, রহিমা প্রাথমিকভাবে পুলিশকে কিছুই জানাননি, কেবলমাত্র চোখের পানি ফেলেছেন।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু ভিকটিমকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, আর মামলাটি তদন্ত করেছে পিবিআই। সুতরাং পিবিআইয়ের তদন্তে ভিকটিমের নিখোঁজ বা আত্মগোপনের বিষয়ে তদন্ত করলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।

চলতি বছরের ২৭ আগস্ট রাত আনুমানিক ১০টার দিকে খুলনা মহানগরীর মহেশ্বরপাশার উত্তর বণিকপাড়ার নিজ বাসা থেকে টিউবওয়েলে পানি আনতে গিয়ে রহিমা বেগম নিখোঁজ হন বলে অভিযোগ করে তার পরিবার। এরপর আর ঘরে ফেরেননি তিনি। স্বামী ও ভাড়াটিয়ারা নলকূপের পাশে ঝোপঝাড়ে তার ব্যবহৃত ওড়না, স্যান্ডেল ও বালতি দেখতে পান। সেই রাতে মাকে খুঁজতে আত্মীয়-স্বজন, আশপাশসহ সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ না পেয়ে পরেরদিন রহিমা বেগমের মেয়ে আদুরী খাতুন দৌলতপুর থানায় মামলা করেন।

‘নিখোঁজ’ হওয়ার পর প্রতিবেশী হেলাল শরীফের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে ঝামেলার কথা উল্লেখ করে তাদের নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন রহিমা বেগমের মেয়েরা। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় হেলাল শরীফ এখনও জেল হাজতে। তার মেয়ে অন্তরা ফাহমিদা এখন বলছেন, ‘প্রমাণিত হলো, রহিমা বেগমের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে আমার বাবা হেলাল শরীফ নির্দোষ। কিন্তু তাকে তো বিনা দোষে জেল খাটতে হচ্ছে। এর ফয়সালা কে দেবে? আল্লাহ সব সময় সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আমরা এখন চূড়ান্ত সত্য দেখার অপেক্ষায়।’

সর্বশেষ পিবিআই মামলাটির তদন্ত করছিল। এরপর গত ২২ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) রাত ১১টার দিকে মরিয়ম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন ‘আমার মায়ের লাশ পেয়েছি মাত্র’ এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোরগোল পড়ে যায়। শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ময়মনসিংহের ফুলপুর থানায় উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত এক নারীর মৃতদেহের পোশাক দেখে, তাকে নিজের মা দাবি করেছিলেন মরিয়ম মান্নান। তবে পরেরদিন শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাতে ফেসবুকের মাধ্যমে মরিয়ম জানান, তার মায়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। খুলনার পুলিশ সুপার তাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছেন।  

এদিকে রহিমা খাতুন কীভাবে কুদ্দুসের বাড়িতে গেলেন? এতদিন কোথায় ছিলেন? সবার মনে এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা চলছে। এসব বিষয়ে রহিমাকে উদ্ধারকারী টিমের নেতৃত্ব দেওয়া দৌলতপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার আব্দুর রহমান বলেন, ‘২৮ বছর আগে খুলনার সোনালী জুট মিলে চাকরি করতেন কুদ্দুস বিশ্বাস। তখন তিনি পরিবার নিয়ে রহিমার বাসায় ভাড়া থাকতেন। ওই সময় রহিমার পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে কুদ্দুসের পরিবারের। কয়েক বছর আগে কুদ্দুস পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসেন। তাদের মধ্যে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হতো। সম্প্রতি পারিবারিক নানা বিষয় নিয়ে রহিমার সঙ্গে স্বামীর কলহ চলছিল। এ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আত্মগোপন করেন রহিমা। নিখোঁজের পর কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করেছেন। এজন্য তার লোকেশন শনাক্ত করতে বেগ পেতে হয়েছে আমাদের। গত ১৭ সেপ্টেম্বর কুদ্দুসের বাড়িতে যান রহিমা। এরপর থেকে সেখানেই ছিলেন তিনি।

কীভাবে পুলিশ তার সন্ধান পেয়েছে জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘নিখোঁজের পর থেকেই তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির ভিত্তিতে আমরা তার সন্ধান বের করার চেষ্টা করছিলাম। এরই মধ্যে ময়মনসিংহের ফুলপুরে অজ্ঞাত এক নারীর লাশকে নিজের মায়ের দাবি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান। তবে আমরা গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রেখেছিলাম। সেইসঙ্গে নিখোঁজের আগে রহিমার সঙ্গে যাদের মোবাইলে যোগাযোগ হয়েছিল, তাদের মোবাইল নম্বর ট্র্যাকিং করে লোকেশন শনাক্তের চেষ্টা করেছি। শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি, কুদ্দুস বিশ্বাসের বাড়িতে অবস্থান করছেন রহিমা। এরই ভিত্তিতে ওই বাড়িতে গিয়ে আমরা তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। বিস্তারিত সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দেবো আমরা। এখন খুলনা থানা পুলিশের হেফাজতে আছেন রহিমা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়