শাহাজাদা এমরান, কুমিল্লা: সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির অপূর্ব নির্দশন কুমিল্লা ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। এখানে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের সৈনিকদের কোন ভেদাভেদ না করে সমাধিস্থকরা হয়। শুধু তাই নয় মিত্র বাহিনীর পাশাপাশি তৎকালিন শত্রু বাহিনীর নিহত ২৪ জন জাপানী সৈনিকদেরও এখানে সমাধি করা হয়েছে।
জানা যায়,শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের উত্তর কোন ঘেষে কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পশ্চিম পাশে বুড়িচং উপজেলায় এর অবস্থান। প্রায় সাড়ে চার একরের উচু নীচু টিলাভূমিতে এটি অবস্থিত ।
স্থানীয়রা এটিকে ইংরেজ কবরস্থান নামেও ডেকে থাকে। এ সমাধি ক্ষেত্রটি দুই স্তরে বিভক্ত। মূল ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করলে দেখা য়ায় দু পাশে সাজানো সমাধি। সামনে সিড়ি বেয়ে কিছুটা উঠলে প্রার্থনা কক্ষ আর মাঝে শ্বেত পাথরের যীশু খৃীষ্টের ক্রুশের চিহ্ন।
১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সালে সংগঠিত দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে নিহত ৭৩৮ জন মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সৈনিকরা শায়িত আছেন কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কুমিল্লার ময়নামতিতে ছিল মিত্র বাহিনীর চিকিৎসা কেন্দ্র। যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা সেবা দিতে এখানে নিয়ে আসা হতো বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে শুধু মিত্র বাহিনীর সৈনিকদের সমাহিত করা হয়নি। এখানে জাপাান সৈনিকদের ও সমাহিত করা হয।
১৯৪১-৪৫ সাল পর্যন্ত সময়ে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিক্ষেত্র ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে রয়েছে ৭৩৮টি সমাধিস্থল। তবে ১৯৬২ সালে এক সমাহিত সৈনিকের দেহাবশেষ আত্মীয়-স্বজনরা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেলে বর্তমানে এর মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৩৭টি সমাধিক্ষেত্র। এখানে সমাহিত ১ জন রয়েছেন বেসামরিক ব্যক্তি।
সাবেক বার্মা বর্তমানে মিয়ানমারে সংগঠিত দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে যে ৪৫ হাজার সৈনিক নিহত হয় তাদের বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে ৯টি স্থানে সমাধিস্থকরা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশে এদের সমাধি রয়েছে দুটি। একটি কুমিল্লার ময়নামতি আর অপরটি চট্রগ্রামে। প্রতিটি সমাধিতে লেখা আছে নিহত সৈনিকের নাম, বয়স, পদবীসহ মৃত্যুর তারিখ ও জাতীয়তা। এ সমাধিক্ষেত্রটি বর্গাকৃতির।
প্রতিটি বাহুর দৈঘ্য প্রায় আড়াইশ ফুট। সমাধিক্ষেত্রটির চারিদিকে প্রতিরক্ষা বেড়া রয়েছে। প্রতিটি সমাধির পাশে অনেক রকম ফুল ও পাতাবাহার গাছ দ্বারা সৌন্ধর্য বর্ধন করা হয়েছে।
১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রথমে বার্মায় ( মিয়ানমার) সংগঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ। পরবর্তী পর্যায়ে ছড়িতে পড়ে সমগ্র বিশে^। এই যুদ্ধে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে প্রায় ৪৫ হাজার সৈনিক নিহত হয়। যাদের বেশির ভাগই ছিল অবিভক্ত ভারতের মুসলিম সৈনিক।
১৯৪১ সালে বার্মার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ব্রিটিশ ভারতীয় ও স্থানীয় সৈনিকদের দুটি দুর্বল ডিভিশনে সংঘটিত করা হয়, যার একটি বার্মার রেংগুনের দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথ রক্ষার জন্য এবং অন্যটি মধ্য বার্মাকে পূর্ব দিকের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য।
কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রির সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন কমন ওয়েলথ গ্রেভস কমিশন। এর প্রধান কার্যালয় লন্ডনে।
সমাধি সৌধোর তত্ত্বাবধায়ক গিয়াস চৌধুরী জানান, বছরে দুই ঈদের দিন ছাড়া সপ্তাহের ছয়দিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা এবং ১ ঘন্টার মধ্যাহ্ন বিরতি দিয়ে দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ যুদ্ধ সমাধিস্থল সর্ব সাধারণে জন্য উন্মক্ত থাকে। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত ভ্রমণকারী দেখতে আসে এ সমাধি সৌধ। সবাই শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে এই বীর সৈনিকদের। যারা দ্বিতীয় বিশ^ যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন শত্রুুর বোমার আঘাতে কিংবা বন্ধুকের গুলিতে। সম্পাদনা: ইমরান শেখ
প্রতিনিধি/আইএস