অপূর্ব চৌধুরী: [২] বিউটি আড্ডার প্রাণ পুরুষ ছিলেন কবি শহীদ কাদরী। তাকে সঙ্গ দিতেন কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক ও কবি বেলাল চৌধুরী। তাদের অনুপ্রেরণায় বিউটি বোর্ডিংয়ে গড়ে উঠেছিল জমজমাট আড্ডার পরিবেশ ও সৃষ্টিশীল কর্মকান্ড। এই চিত্র ছিল বিউটি বোর্ডিং প্রতিষ্ঠাকালীন সময় অর্থাৎ ১৯৪৯ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছর পর্যন্ত। তবে এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সেই সাহিত্য আড্ডার জায়গাটিই বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে ছবি তোলার জন্য।
[৩] হরেক রকমের ছবি কিংবা ফটোশুটের জন্য তরুণ-তরুণী, মধ্যবয়সী এবং প্রবীণরাও ছুটে যান বিউটি বোর্ডিংয়ে। অথচ জন্মলগ্ন থেকেই বিউটি বোর্ডিংয়ে সান্নিধ্য দিতে শুরু করেন কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিল্পী, চলচ্চিত্রসেবী, রাজনীতিবিদ, নৃত্যশিল্পী, গায়ক,সুরকার অভিনেতা, ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ।
[৪] এখানেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বসে সভা করেছেন বলে জানা যায়, দিয়েছেন বিভিন্ন দিকনির্দেশনা। এখানে বসেই আব্দুল জাব্বার খান প্রথম স্ববাক বাংলা চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশের পান্ডুলিপি রচনা করেন। এছাড়া কাচের দেয়ালসহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের পান্ডুলিপি এখান থেকেই রচিত হয়েছিল।
[৫] মুক্তিযুদ্ধেও বিউটি বোর্ডিংয়ের অবদান ছিল অনবদ্য। যুদ্ধের শুরুতে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। এখানে বিউটি বোর্ডিংয়ের কর্ণধার প্রহ্লাদ সাহাসহ মোট ১৭ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে বোর্ডিংটি দখলে নেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর প্রহ্লাদ সাহার স্ত্রী প্রতিভা রাণী সাহা কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সহায়তায় বোর্ডিং পুনরায় চালু করেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে ডিভাইসের তেমন প্রচলন না থাকায় এসবের স্মৃতিমূলক তেমন কোন ছবিও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।
[৬] বর্তমান সময়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা বিউটি বোর্ডিং যেন প্রাণবন্ত সব স্মৃতিকে ক্যামেরায় ধারণের জন্য সমৃদ্ধ জায়গা। পুরান ঢাকাবাসী,আশেপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এবং দূরে থাকা মানুষের জন্যও এই বিউটি বোর্ডিং এক ফটো স্টুডিও হয়ে উঠেছে যেন।
[৭] থাকা এবং চা, দই-চিড়া, পায়েসের পাশাপাশি রূপচাঁদা মাছ, পোয়া মাছ, ইলিশ মাছ, রুই কাছ, মুরগী, খাশির মাংসের মত সুস্বাদু বাঙ্গালি খাবারের সমাহার থাকার পরও এসবের চেয়ে ছবি তোলাটাই যেন প্রিয় বর্তমানে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন থেকে ধরে প্রায় প্রতিদিনই মানুষ বিউটি বোর্ডিংয়ে যায় ছবি তোলার জন্য। সেলফি, গ্রুপ ছবি কিংবা ভিডিও ধারণ কোনকিছুরই যেন কমতি থাকেনা।
[৮] সম্প্রতি বিউটি বোর্ডিংয়ে গিয়ে দেখা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইশা রহমান নামের এক শিক্ষার্থী এসেছেন ছবি তুলতে। ছবি তুলে দিচ্ছিলেন মাইশার বন্ধু নাসিম হোসাইন ও রেজাউল করিম। যারা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাইশার ছবি তোলা শেষে নাসিম ও রেজাউলও গ্রুপ ছবি তোলেন।
[৯] নাসিম হোসাইন বলেন, মানুষ এখন কোলাহলপূর্ণ জায়গা পরিহার করতে চান। ছবি তোলার জন্য সবাই শান্তিপূর্ণ জায়গা বাছাই করে। বিউটি বোর্ডিং একটি শান্তিপূর্ণ জায়গা। আমরা মাঝেমধ্যেই বিউটি বোর্ডিংয়ে আসি ছবি তোলার জন্য। আমাদের ছবি দেখে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু ছবি তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং আজকে চলে আসে ছবি তোলার জন্য। তাকেও ছবি তুলে দিতে পেরে আমরা আনন্দিত।
[১০] রাজধানীর খিলগাঁও থেকে বিউটি বোর্ডিংয়ে ছবি তুলতে এসেছেন শ্রুতিলেখা বিশ্বাস। সাথে দুই বান্ধবী। প্রায় এক ঘন্টা ধরে তারা ছবি তুললেন বিভিন্ন ভঙ্গিমায়।
[১১] শ্রুতিলেখা বিশ্বাস বলেন, বিউটি বোর্ডিংয়ে আর গল্প-আড্ডা হয়না আগের মত। কিন্তু পরিবেশটা সবসময় নিরিবিলি থাকে। এখানে আগে লেখক কবিরা আসত তাদের একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে শুনেই প্রথমবার গিয়েছিলাম। তারপর গিয়ে দেখি চারপাশটা সুন্দর, ছবি তোলার মত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, গাছপালা দিয়ে সাজানো। সেটাও ছবি তোলার মত একটা পরিবেশ তৈরি করে। আর ছবি তোলা এই জায়গাটার প্রবণতা হয়ে গেছে। আমার ছবি দেখে আরও কয়েকজন এই জায়গায় গিয়ে ছবি তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল।
[১২] কেবল নাসিম, রেজাউল, মাইশা বা শ্রুতিলেখা বিশ্বাসই নয়। বছরের পর বছর ধরে পুরান ঢাকা এবং ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বাস করা অনেকেই আসেন প্রতিনিয়ত বিউটি বোর্ডিংয়ে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ সহ আশেপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরও ছবি তোলার ক্ষেত্রে পছন্দের জায়গা এই বিউটি বোর্ডিং।
[১৩] কেউ যান একা, আবার কেউ কেউ যান দলবেঁধে। ছবি তোলার পর হাসিমুখেই ফিরেন সেখান থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সয়লাব থাকে এসব ছবি। আর ছবি তোলার বিখ্যাত স্থানে পরিণত হয়েছে বলেই বিউটি বোর্ডিংয়ের অস্তিত্ব পেয়েছে নতুন মাত্রা।
প্রতিনিধি/একে
আপনার মতামত লিখুন :