শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা ◈ জনগণকে সংগঠিত করে চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করতে হবে: মির্জা ফখরুল

প্রকাশিত : ১০ জানুয়ারী, ২০২২, ০১:৪৭ রাত
আপডেট : ১০ জানুয়ারী, ২০২২, ০১:৪৭ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং বিজয়ের তাৎপর্য

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পাঠানো হয় পাকিস্তানের নির্জন কারাগারে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি অসহনীয় নির্যাতনের শিকার হন। প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে তিনি মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকেন। পাকিস্তানের কারাগারে গোপনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সকল প্রকার আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এ ঘটনা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৬৭টি দেশের সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিঠি দেন। অন্যদিকে তিনি ইউরোপের ৫টি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে বিশ্বজনমত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন। ফলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে দ্রুত গতিতে ঘটনার স্রোত এগিয়ে চললো। দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে চললো মুক্তি সেনাবাহিনী। ইতোমধ্যে ঢাকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে পিন্ডির রাজনীতি মঞ্চে নতুন খেলা শুরু হলো। ভুট্টোকে ডেকে পাঠানো হলে পিন্ডিতে। আমেরিকা থেকে ভুট্টো ছুটে এলেন। অবশেষ কয়েকদিন পর পাক বেতারে ঘোষণা করা হলো যে ভুট্টো তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন। বাংলাদেশের মানুষ তথা সারাবিশে^র শান্তিকামী মানুষ স্বস্তির নিঃশ^াস ফেললেন। বেঁচে আছেন শেখ মুজিব, বাংলার মহানায়ক। আর তাঁকে হত্যা করতে সক্ষম হবেন না। অবশেষ ভুট্টো ঘোষণা করলেন শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়া হবে। ৮ জানুয়ারি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান রাষ্ট্রপতি মুক্তি পেলেন শত্রুর কারাগার থেকে। কিন্তু তাঁকে বাংলাদেশে না পাঠিয়ে বিমানযোগে গোপনে পাঠানো হলো লন্ডনে। রাত ৪টায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে বিদায় দিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তানি বিশেষ বিমানটি বাংলাদেশ সময় ১২টা ৩৫ মিনিটে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করলো। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানালেন গ্রেট ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত প্রধান মি. আয়ান সাদারল্যান্ড। শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য বি. ব্রুস ডগলাস ম্যান এবং মি. পিটার শোর। লন্ডনের মাটিতে পা রেখেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিনকে প্রথম কথাটি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার দেশের মানুষ কেমন আছে? বর্বর পাক সেনাবাহিনী কি আমার দেশবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে? মৃত্যুর জন্য বঙ্গবন্ধু প্রস্তুত ছিলেন। যেদিন তিনি জেলে যান সেদিন জানতেন, হয়তো জেলের নির্জন প্রকোষ্ঠে তাঁর জীবনাবসান হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হবে। সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে তিনি বলেন, আজ আমার দেশের মানুষ মুক্ত, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমার কোনো বিদ্বেষ নেই’।

বিশে্বর সাংবাদিকরা স্তব্ধ বিস্ময়ে শুনেছে বাংলার মহানায়কের এ উদার ঘোষণা। লন্ডন থেকে স্বদেশের পথে দিল্লিতে এক আবেগ আপ্লুত সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন ভারত সরকার। বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি তাঁকে স্বাগত সংবর্ধনা জানালেন। সংবর্ধনা জানালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। একুশবার তোপধ্বনিতে পালাম বিমানবন্দরে মাটি ফেটে ওঠলো। সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠলো দুই দেশের জাতীয় সংগীত। ভারতের উদ্দেশ্যে মহানায়ক বললেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার জন্য আমি ভারতের জনগণ, ভারত সরকার এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি’। আমি সালাম জানাই মুক্তি বাহিনীকে, গেরিলা বাহিনীকে, কর্মী বাহিনীকে। আমি আরও সালাম জানাই সংগ্রামী কৃষক শ্রেণিকে, কৃষক ভাইদের আর বুদ্ধিজীবীদের। তারপর বাংলার সভা মঞ্চে এক আবেগঘন মুহূর্ত তাঁর দু’চোখ থেকে অবিরল ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মহানায়ক ছোট্ট শিশুর মতো কাঁদছেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলার মানুষের জন্য, আর হারানো সঙ্গীদের জন্য। আর বাংলার মানুষ এই মহানায়ককে করতালি দিয়ে হর্ষধ্বনি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করছেন। মহানায়ককে ফিরে পেয়ে যেন তারা এক নতুন জীবনের স্বপ্নে সমস্ত ব্যথা-বেদনা ভুলে আনন্দের হাসি হাসছে। এভাবেই বাংলার মহানায়কের ফিরে আসাকে অনন্তকাল ধরে বাংলার মানুষরা আবেগ, আনন্দ অনুভূতির সঙ্গে মিশিয়ে চিরকাল ধরে স্মরণ করতে থাকবে।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির জন্য একটি বড় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে বাঙালি যখন বাস্তবতার মুখোমুখি- তখন পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুযন্ত্রণা শেষে লন্ডন-দিল্লি হয়ে মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে ফেরেন। বঙ্গবন্ধু ঢাকা এসে পৌঁছেন ১০ জানুয়ারি। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য প্রাণবন্ত অপেক্ষায় ছিলো। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। বিকাল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন।

রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু সেদিন যে ভাষণ দেন, তা ৭ মার্চের ভাষণের মতোই মূল্যবান। বাংলার মানুষ তাদের প্রিয় নেতাকে তাদের মধ্যে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি যে কতোটা প্রয়োজন ছিলো, তা এখনকার প্রজন্মের অনেককেই বোঝানো সম্ভব নয়। তখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেকেই মনে করছিলেন, ‘আমরা সবাই রাজা’। কেউ কাউকে মানছিলেন না। তরুণ নেতারা অস্থায়ী সরকারের কোনো কথা শুনছিলেন না। একটি নৈরাজ্যের মতো অবস্থা ছিলো ২৫টি দিন। তিনি না এলে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিতে চাইতেন না সহজে। ভারতীয় সৈন্যও হয়তো অত তাড়াতাড়ি ফিরে যেতো না। অনেক দেশের স্বীকৃতি পেতেও বেগ পেতে হতো। তাঁর প্রত্যাবর্তনের দিন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংহত হয়। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যা ছিলো জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যারা দালালী ও সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ, মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, এসব বিষয়সহ বিভিন্ন দিক নিয়ে নির্দেশনা। তিনি ডাক দিলেন দেশ গড়ার সংগ্রামে। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত মন্ত্রমুগ্ধ জনতা দু’হাত তুলে সেই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সংক্ষেপিত।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক, সাবেক উপ-মহাপরিচালক আনসার ও ভিডিপি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়