শিরোনাম
◈ সিলেটে ট্রাক-অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত ২ ◈ থাইল্যান্ডের রাজা-রাণীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ ◈ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় ◈ শিক্ষক নিয়োগ: ১৪ লাখ টাকায় চুক্তি, ঢাবি শিক্ষার্থীসহ গ্রেপ্তার ৫ ◈ বিদ্যুৎ-গ্যাস কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া ঋণ মিলবে না ◈ রোববার খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান  ◈ নতুন করে আরও ৭২ ঘণ্টার তাপ প্রবাহের সতর্কতা জারি ◈ উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ব্যর্থ হলে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হতে পারে: সিইসি ◈ ভারতের রপ্তানি করা খাদ্যদ্রব্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পেয়েছে ইইউ ◈ ৯৫ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা বিলে জো বাইডেনের স্বাক্ষর

প্রকাশিত : ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ০২:৩৩ রাত
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ০২:৩৩ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মানবর্দ্ধন পাল: শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু : ‘ডাল’

মানবর্দ্ধন পাল: ‘ডাল’ শব্দটি একাধিক অর্থ প্রকাশক। শস্যদানা ও গাছের শাখা-প্রশাখা- এর প্রধান অর্থ। শব্দের ব্যবহার, প্রয়োগ এবং উপযোগিতার মধ্যেই এর অর্থের মুখ্যতা-গৌণতা নির্ভর করে। তাই এ দুটোর মধ্যেও প্রধানতর অর্থ মনে হয় শস্যদানাই। জীবনধারণে খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা এক নম্বরে বলেই শস্যদানা হিসেবে ডালও এর প্রায় সমমর্যাদার। স্বল্প চাহিদার সাধারণ বাঙালির জীবনে ডালভাত প্রিয় খাবার- ‘গরিবের গরিবানা/ লবণ দিয়া পিঠা বানা’- এই প্রবাদের মতো। প্রাচীনকালে বাঙালি জাতিসত্তার একটি অন্যতম কুললক্ষণ ছিলো ‘মাছেভাতে’ বাঙালি। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’- কবি ভারতচন্দ্রের এমন চাহিদা কেবল শুভময় প্রার্থনাবাক্য হিসেবেই রয়ে গেছে। সাধারণ বাঙালি জীবনে কখনো ফলবতী হয়েছে বলে মনে হয় না। ইতিহাসের কালপ্রবাহে বাঙালি নানান পর্যায়ে জয়ী হয়েছে কিন্তু দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কখনো বিজয়ী হতে পারেনি। মাছভাত ও দুধেভাতের পরে নিম্নবিত্তের জীবনে এলো ন্যূনতম ডালভাতের চাহিদা। তাও যখন স্বপ্নের মতো পরে এসেছে শাকভাত ও নুনভাতের প্রসঙ্গ। ডালভাত, শাকভাত, নুনভাত- এই শব্দগুলোর আলঙ্কারিক তাৎপর্যও আছে। আমাদের শৈশবে লক্ষ্য করেছি, সামাজিক বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে- তা যতো বড়ই হোক- নিমন্ত্রণপত্রের কোনো প্রচল ছিলো না।

মুখেই নিমন্ত্রণ করা হতো। ব্যতিক্রম ছাড়া আমন্ত্রক নিজেও তা করতেন না। একজন বিশ্বস্ত লোক দিয়ে নিমন্ত্রণের কাজটি সারতেন। তাতে কেউ কিছু মনে করতো না। আমাদের এলাকায় খয়রাকুড়ি গ্রামে সমরেন্দ্র সরকার নামে পিতার বয়সী একজন মানুষ ছিলেন। তিনিই সকলের পক্ষ থেকে সামাজিক ও পারিবারিক সব নিমন্ত্রণের কাজটি বিশ্বস্ততার সঙ্গে করতেন। এজন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিক বা উপঢৌকন প্রাপ্তির চিন্তা করতেন না। আমরা তাঁকে সমরকাকু ডাকতাম। তিনি নিমন্ত্রণের তালিকাটি নিয়ে আশপাশের গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিমন্ত্রণ করতেন। ধুতির সঙ্গে পুরনো দিনের পাশপকেটওয়ালা ফুলহাতা শার্ট পরে কাঁধে একটি গামছা রাখতেন। উঠানে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে তিনি বলতেন, অমুকের পরিবর্তে আমার নিবেদন, অমুকের প্রথম/দ্বিতীয় পুত্র/কন্যার বিবাহ বা অমুকের পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনির অন্নপ্রাশন অথবা অমুকের পিতা-মাতার শ্রাদ্ধ উপলক্ষে... তারিখ... বার মধ্যাহ্নে আপনার/আপনাদের ডালভাত, শাকভাত, নুনভাত সেবা গ্রহণের নিমন্ত্রণ। এ ধরনের নিমন্ত্রণে বিনয়-ভদ্রতা এবং অতিমাত্রিক সৌজন্য আছে ঠিকই- আছে আলঙ্কারিক প্রকাশের সৌন্দর্যও। সেই নিমন্ত্রণের খাদ্য তালিকায় নুন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে শাক, ডালভাতও নয়। সেখানে ‘ডালনা’ থাকলেও ‘ডাল’ থাকে অপাঙক্তেয়। থাকলেও সুস্বাদু দেশি, বিদেশি, মোগলাই খাবার আর সপ্তব্যঞ্জনে ভরপুর থাকে খাদ্যমঞ্চ। এটাই বচনের আলঙ্কারিকতা এবং খাঁটি বাঙালিয়ানা।

‘ডাল’ শব্দটি তদ্ভব। সংস্কৃত দল বা দল্লক শব্দ থেকে- দল্লক>দল>দাল> ডাল (দ>ড)। বিদারিত শস্য দলন করে বা পিষে খোসা ছাড়িয়ে যা পাওয়া যায় তাই দাল বা ডাল। মুগ, মসুরি, বুট, খেসারি, ছোলা, কলাই, মটর ইত্যাদি শস্য আমাদের প্রধান ডাল। কথায় বলে, ডালের মজা তলে। দইয়ের ওপরের অংশ ও ঘোলের নিচের অংশ যেমন মজাদার তেমনই ডালের নিচের অংশ। খাওয়ার শেষে পাতলা মসুর ডালের স্বাদ নেয়নি এমন বাঙালি নেই। মনে পড়ে সিকি শতাব্দী আগের কথা। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হলের ক্যান্টিনের মধ্যে ডাল প্রতিযোগিতা হয়েছিলো। প্রথম হয়েছে জগন্নাথ হলের ডাল। ঘনত্ব মেপে দেখা গেছে সে হলের ডালই সবচেয়ে পাতলা- যেন খাওয়ার পর হাতধোয়া হালকা হলুদরঙা পানির মতো। এই তরলতম ডালের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সরস পঙক্তি মনে পড়লো: ‘পঞ্চাশ টাকা বেতনের ডালভাত এবং তদীয় স্ত্রীর বাক্যঝাল খাইয়া নীরবে পরিপাক করিতে লাগিলো।’

তাছাড়া নাস্তার উপকরণ হিসেবে অন্য পদের সঙ্গে সমাসবদ্ধ হয়ে কতো রূপ ধারণ করে হয়- ডালভাজি, ডালচচ্চড়ি, ডালমুট, ডালপুরি, ডালবাটা, ডালভর্তা ইত্যাদি সব নানান স্বাদের খাদ্যেরই উপকরণ। ডালেচালে খিচুড়ি হয়। প্রবাদ হিসেবে জগাখিচুড়ির কথা কে না শুনেছে। পৌরাণিক দেবতা জগন্নাথদেবের মন্দিরের ঐতিহ্যবাহী খিচুড়ি প্রসাদ থেকেই এসেছে ‘জগাখিচুড়ি’ প্রবাদ। গণপ্রসাদ বিতরণের সময় বিশৃঙ্খল অবস্থাই জগাখিচুড়ি প্রবাদের মর্মার্থ। কবিগুরুর গানের ভাষায়- ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে’ কোন বাঙালি খিচুড়ির স্বাদ গ্রহণ করেনি? বাঙালির এক বিচিত্র স্বাদের খাবার ডালের বড়ি। কলাইডাল ফেটিয়ে ও কড়া রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয়। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর একুশের কবিতায় আছে: ‘ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি- খোকা তুই কবে আসবি।’ শহীদ পুত্রের জন্য মাতৃহৃদয়ের হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে এই কাব্যপঙক্তিতে। ডালের আরেক অর্থ- গাছের শাখা-প্রশাখা। বিভিন্ন প্রাকৃত ও মাগধি ভাষায়ও শব্দটি পাওয়া যায়। প্রাচীনতম কাব্যগ্রন্থ চর্যাপদে আছে: ‘কায়া তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।’ চণ্ডীদাসে পাই: ‘তরুকুল ডাল, ফুলভরি ভাল, সৌরভে পুরিলো তায়।’

রবীন্দ্রনাথের শীত ঋতুর একটি বিখ্যাত গান: ‘শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন আমলকির ওই ডালে ডালে।’ তাঁর একটি শিরোনামহীন ছড়ায় আছে: ‘কাল ছিলো ডাল খালি/আজ ফুলে যায় ভরে/ বল দেখি তুই মালী/হয় তা কেমন করে।’ ডালচিনি বলেও বাংলায় একটি শব্দ আছে। সংস্কৃত ‘দারুচিনি’ থেকে এর উৎপত্তি। মসলা ও ঔষধে ব্যবহৃত বৃক্ষবিশেষের মিষ্টি ত্বক বা বাকল। ডাল-কুকুর বা ডালকুত্তা বলেও একটি শব্দ আছে। এর অর্থ- শিকারি কুকুর। নজরুলের ‘লিচুচোর’ কবিতায় আছে: ‘বাবুদের ডাল-কুকুরে সে কী বাস করলে তাড়া।’ শিকার ধরার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই দ্রুতগামী কুকুরকে শিকারের পেছনে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। হিন্দিতে ‘ডাল’ শব্দের অর্থ: ছেড়ে দেওয়া বা ফেলে দেওয়া। হিন্দিতে ‘ডালকুত্তা’ শব্দটি এই অর্থেই তৈরি। শিকার ধরার জন্য যে কুকুর ছেড়ে দেওয়া হয় তাই ‘ডালকুত্তা’। হিন্দি ‘ডাল’ শব্দটি মুক্তিযুদ্ধের শেষাংশে একাত্তরের ডিসেম্বরে প্রচুর শুনেছি। পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের সময় ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশ ছিলো: ‘হাতিয়ার ডাল দো।’ এর সঙ্গে মিশে আছে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের আনন্দ।

গাছের শাখা-প্রশাখা অর্থে ‘ডাল’ থেকেই ডালা, ডালি, ডালপালা- এ শব্দগুলোর উৎপত্তি। সরু ও পাতলা বাঁশের চাঁচ দিয়ে বানানো বিবিধ উপকরণ, বিশেষত শুভকর্ম বা পূজার উপচার রাখার পাত্রকে ডালা বা ডালি বলে। আলঙ্কারিক অর্থেও এর ব্যবহার আছে: [১] ‘পুত্র তোর ঘরে, ভ্রমসী নগরে যৌবন করিয়া ডালি।’ (নজরানা অর্থে, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী)। [২] ‘অবলা প্রবলা পাপ কলঙ্কের ডালি।’ (আধার অর্থে, কৃষ্ণরাম)। [৩] ‘রূপের ডালি খুলে বসি পেতেছে দোকান।’ (ভাণ্ডার অর্থে, হেমচন্দ্র)। [৪] ‘আমি তোমাকে ডালি পাঠাইবো, তুমি মনে রাখিও।’ (বঙ্কিমচন্দ্র)। [৫] ‘ও মা কালী দিবো ডালি, অনুকূলা হও।’ (শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্থে, ঈশ্বর গুপ্ত)। ডাল, ডালা, ডালি নিয়ে যতোই ডালপালা বিস্তার করি না কেন সবই হবে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ও নিন্দার্থে ‘বাক্যনবাবি’। সুতরাং ক্ষান্ত দিলাম। লেখক : প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থকার

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়