শিরোনাম
◈ ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে একই পরিবারের পাঁচজন ◈ স্থায়ী জামিন না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছি ড. ইউনূসের আইনজীবী ◈ উপজেলার ভোটে এমপি-মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপ না করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছে: ওবায়দুল কাদের  ◈ শ্রম আইন লঙ্ঘন: ড. ইউনূসসহ ৪ জনের জামিন ২৩ মে পর্যন্ত বৃদ্ধি ◈ ময়মনসিংহে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ২৬ ◈ ফরিদপুরে বাস-পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিহত বেড়ে ১৩  ◈ ইরানের হামলার জবাব দেবে ইসরায়েল: সেনাপ্রধান ◈ সৌদিতে কোরবানি ঈদের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা ◈ শ্রম আইন লঙ্ঘনের সাজাপ্রাপ্ত মামলায় স্থায়ী জামিন চাইবেন ড. ইউনূস ◈ স্বাস্থ্যখাতে নতুন অশনি সংকেত অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: স্বাস্থ্যমন্ত্রী 

প্রকাশিত : ০৩ ডিসেম্বর, ২০২১, ০৫:২৬ সকাল
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর, ২০২১, ০৫:২৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

নবনীতা চক্রবর্তী: পয়ষট্টি শতাংশ তারুণ্যনির্ভর দেশে তরুণদের উপর আস্থা রাখতেই হবে

নবনীতা চক্রবর্তী: “ওরে নবীন ওরে কাঁচা আধমরাদের ঘা দিয়ে তুই বাঁচা “ বোধ করি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ঘা শব্দটিকে একটি নবজোয়ার বা নতুন প্রাণ সঞ্চার করার অর্থেই ব্যবহার করেছেন । যেখানে তরুণরা তাদের নতুন সৃষ্টি সত্তা দিয়ে ,সৃজনশীলতা দিয়ে উদ্যম দিয়ে পৃথিবীকে প্রাণ প্রাচুর্যময় করবে । তাদের কর্ম দিয়ে সমৃদ্ধি ঘটাবে । বিধিবাম , বর্তমান যুব সমাজ বা তরুণ প্রজন্মের দশা অবলোকন করলে কবিগুরু কী লিখতেন বা পরামর্শ দিতেন- তা জানি না তবে চিত্র বড়ই চিন্তাদায়ক।

হতাশা জ্ঞাপন করা এই লেখনীর উদ্দেশ্য নয় । বরং বর্তমান পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করা ও তার সমাধান খোঁজাই মূল লক্ষ্য । একটি প্রশ্ন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তরুণরা কেন সহিংসতার দিকে ঝুঁকছে ?  কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।

গণমাধ্যমের সূত্রমতে , এই ১৯ অক্টোবরের ঘটনা । দাদা মোস্তাফাকে খুজঁতে বের হয় নাটোরের লালপুর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের ৭ বছরের শিশু জেমি । তারপর পাশের বাড়ির কিশোর ইমরান তাকে তার নিজ বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে ।  ধর্ষণের পর  গলা টিপে হত্যা করে লাশ পলিথিনে মুড়ে লুকিয়ে রাখে বাড়ির টয়লেটে তারপর একসময় ফেলে দেয় পাশের ধানক্ষেতে । পরের দিন সকালে সেই লাশ উদ্ধার  করে পুলিশ ।

রাজধানীর কামরাঙ্গীর  চরের কয়লাধাট এলাকায় পায়ে পা দেওয়ার মতো ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যার শিকার হয় সিফাত নামে ১২ বছরের কিশোর । এই হত্যাকাণ্ডে যারা অভিযুক্ত তাদের প্রত্যেকের বয়স ১০ থেকে ১৩ ।

সেইসাথে যুক্ত হয়েছে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি । মোহাম্মদপুর বা উত্তরা ,মধ্যবিত্ত এলাকা বা উচ্চবিত্ত এলাকা ,ঢাকা অথবা ঢাকার  বাইরে এই ধরনের সহিংস উগ্রবাদের সংস্কৃতি তৈরী হচ্ছে । জিরো জিরো নাইন ,  নাইন স্টার, ডিস্কো গ্রুপ, নারা গ্রুপ  নামের ভয়ানক সব কিশোর অপরাধমূলক গ্যাং গড়ে উঠছে । যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রকাশ্যে খুনখারাপি এবং মাদক ব্যবসার মতো কার্যক্রমে জড়াচ্ছে ।

সাম্প্রতিক পীরগঞ্জের হামলায় তরুণদের সম্পৃক্ততা  আবার প্রমাণ করে, তরুণরা কোথায় ভিতরে ভিতরে মারমুখী হয়ে উঠছে , ক্ষমতালিন্সু হয়ে উঠছে , অস্থির হয়ে উঠছে। যেটি নিঃসন্দেহে সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য অশনি সংকেত । এখন অনেকেই আমরা আঙ্গুল তুলব তাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার সাথে । সেটা কিন্তু একমাত্র সমস্যা নয় । কারণ এখন কারো চলন বলন কথার ধরন এমনকি পোশাকের উপস্থাপনে পরিদৃশ্যত হয় এক চিত্র বাস্তবে তার মননশীলতায় ও কর্মে দেখা যায় আরেক চিত্র । যা একেবারেই নৈতিক আর্দশের পরিপন্থী । মুখে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের আর্দশের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রাখলেই যে রাতারাতি সে সেই দলভুক্ত হবেন বা সেই দলের আর্দশ বুঝতে, ধারণ করতে সক্ষম হবেন এমনটা নয় ।

আবার, দলের হয়ে তাকে খুব কাজ করতে দেখা গেলেও আবার তিনি  যখন একটি দ্বায়িত্বশীল অবস্থানপ্রাপ্ত হোন অমনি রাতারাতি তাকেই ভোল পালটে নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে বা উদ্ধারে বেগবান হতে দেখা যায় । এখন এই অনুপ্রবেশকারি ও সুবিধাবাদী দুই ধরনের মানুষ শুধু সংগঠন নয় সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সমান ক্ষতিকর । তাই সাবধান হওয়ার সময় এখনই । কোন রাজনৈতিক দলকে কোন ব্যক্তি বিশেষ যেন তার স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বানাতে না পারে সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব  সেই দলের ।

সমস্যার শিকড় আরো গভীরে প্রোথিত ।  যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা যায় তাহলে অতীত রোহমন্থন করলে দেখা যায় ৭৫ পরবর্তীকালে  ছাত্র রাজনীতির আমূল চরিত্রটাই বদলে গিয়েছে । সেই বদলে যাওয়া চরিত্রে ক্ষুরধার স্লোগান আর লেখনির বদলে অস্ত্র আর অর্থের ঝনঝনানি । বুদ্ধিদীপ্ত রাজনীতির বদলে লাশের রাজনীতির সূত্রপাত । কেন্নো আর কীটদের আগমন ঘটলো রাজনীতিতে । ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দ্বার উন্মোচন করে তৎকালীন ক্ষমতার মসনদে উপবিষ্ট সামরিক জান্তা রাজনীতির এক অন্ধকার অধ্যায়ের সূত্রপাত করলেন । রাজনীতির নতুন ট্যাগ লাইন হল “ মানি ইজ নো প্রবলেম “ । সেই অর্থলিপ্সুতা , ক্ষমতার মোহ, দম্ভ, ধর্মের মোড়কে ফায়দা লোটার মচ্ছবের সূত্রপাত সেখানেই । ক্ষয়িষ্ণু হতে লাগলো সমাজ । যার লাগাম বোধহয় এক পাগলা ঘোড়ার কব্জায়, কিছুতেই বশে আনা যাচ্ছে না ।

রাজনীতি নিঃসন্দেহে সমাজকে প্রভাবিত করে । অন্যদিকে একটা সময় ছিল যখন পারিবারিক অনুশাসন ছিল মজবুত । যেখানে ভয় , শ্রদ্ধা , ভালোবাসা স্নেহ , উদারতা , মানবিক শুভবোধ , সম্প্রীতির চর্চা দায়িত্ব মিলেমিশে সমান্তরাল ভাবে ছিল । এখন এত বেশি আমরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনে নিজেদেরই আবদ্ধ করে ফেলেছি যে, কারোই কারো দিকে তাকানোর সময় নেই, বলা ভালো আমরা দেখার  প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না । আমাদের এখন চারপাশে এত যান্ত্রিক অপশন আছে যে, মানুষের সঙ্গের  প্রয়োজন আর অনুভূত হয় না । হলেও আমরা আসলে মানুষ খুঁজে পাইনা । ফেসবুক, ইউটিউব , ইনস্ট্রাগ্রাম , হোয়াটসএ্যাপ  , টিকটক- এগুলোই এখন আমাদের জীবন ও জগত ।

এখন আমরা পোষাক পরি ফেসবুকের কথা ভেবে ,খাবার খাই বা বেড়াতে যাই ফেসবুকের চিন্তা নিয়ে ।  সকাল থেকে রাত্রি লাগামহীন যার ব্যবহার । প্রিয়জনের সাথে এখন সময় কাটানো মুখ্য বিষয় নয় । ছবি তুলে সেটা ফেসবুকে আপলোড করার মধ্যেই সর্বসুখ নিহিত । তারপর কত লাইক, কমেন্ট আর শেয়ার হল সেটা দেখে পরবর্তী পরিকল্পনা করা । আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের ভালোলাগা , মন্দলাগা শেয়ার করার মধ্যে বিষয়টি আর সীমাবদ্ধ নেই । রীতিমতো এটি আমাদের জীবনের একটি নিয়ামক হয়ে উঠেছে । অদ্ভুত ভাবে এই এ্যাপস গুলো  আমাদের জীবনের নিয়ন্ত্রক। অবিরত একটি কৃত্রিম ও কল্পনামুখী জগতের সাথে থাকতে থাকতে আমরা নিজেরাও অমন মুখোশ আঁটা কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছি । আমাদের সমস্ত মূল্যবোধগুলো আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । আমাদের পারিবারিক বন্ধন গুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে । এই যে আমরা প্রতিনিয়ত একে অপরের থেকে বিছিন্ন হচ্ছি, প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছি,  গলে যাচ্ছি ,পঁচে যাচ্ছি। এই যে অধঃপতন হচ্ছে সেই বোধটুকুও আমরা হারিয়ে ফেলছি । এই বিলাসব্যসনের যাপিত জীবন ধারায়  আমাদের আয়োজন আছে ,আড়ম্বড় আছে , জমকালো আনুষ্ঠানিকতা আছে শুধু নেই হৃদি দিয়ে অনুভবের উষ্ণতা , মানুষের সত্যিকারের সান্নিধ্য ।

এক শুন্যতার গহব্বরে আমাদের ক্রমশ নিমজ্জন ঘটছে । সেই সাথে  সামাজিক স্তরে বৃদ্ধি পাচ্ছে পাশ্বীর্য় সহিংসতা বা হরাইজেন্টাল ভায়োলেন্স । কী সেটা? খুব সহজ ভাবে বললে এটি হল, একটি মানুষের উপর আরেকটি মানুষের নেতিবাচক আচরণের সমষ্টি যার মাধ্যমে নিপীড়ন করা হয় । একজন মানুষকে উপেক্ষা করা , তাকে অসম্মান করা তার অবমূল্যায়ন ঘটানো । তকে ভীত করে তোলা । যার ফলে একটি মানুষের মনে রাগ  ও ক্ষোভ তৈরী হয় । সে আরেকজন মানুষকে তার প্রতিযোগী হিসেবে গণ্য করে । নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন প্রতিপন্ন করে তোলে । ভুগতে থেকে অস্তিত্বের সংকটে । ফলে মানুষের উপর অবিশ্বাস তৈরী হয় । এই প্রক্রিয়ার দ্বারা  সে নিজের আত্মাবিশ্বাস হারাতে থাকে এবং তার সৃষ্টি ক্ষমতা ব্যাহত হতে থাকে ।   কোথাও  আমরা আধুনিকতার মোড়কে নব্য সমাজ তৈরীতে স্থুল নৈতিকতা নির্মাণ করছি । পরিবর্তনশীল দ্বন্দ্বমুখর সমাজ হারাচ্ছে তার মানবিক রূপ হারাচ্ছে নৈতিকতা। তাই বুদ্ধিভত্তিক সামাজিক মূল্যবোধ চর্চার সময় ঠিক এখনই । সুযোগ আর সম্ভাবনা যেমন তৈরী করতে হবে তেমন সেটিকে যথাযোগ্য কাজেও লাগাতে হবে ।

“যদি ভালোবাসা পাই তবে শুধরে নেব জীবনের ভুলগুলো ‘’

আমাদের তরুণ সমাজই সেই ভুল শুধরে নেওয়ার ভালোবাসা । পয়ষট্টি শতাংশ তারুণ্য নির্ভর দেশে তরুণদের উপর আস্থা রাখতেই হবে । তারা করুণা চায় না, বিকশিত হতে চায় । তারা তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সভ্যতার বুকে কল্যাণকর চিহ্ন  রেখে যেতে চায় । তারা কাজী নজরুলের ভাষায় “ঝঞ্জার মতো উদ্দাম / ঝর্ণার মতো চঞ্চল / বিধাতার মতো নির্ভয় /  প্রকৃতির মতো স্বচ্ছল“।

তারা, ”বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন  চিত্ত মুক্ত শতদল ‘’। তারাই ভবিষ্যৎ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন সোনার বাংলা ।

নবনীতা চক্রবর্তী: শিক্ষক , ইউনিভাসির্টি অফ ইনফরমেশন সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি ,ঢাকা , বাংলাদেশ ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়