ফিচার ডেস্ক: প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে অনেক অজানা ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা যায়। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা-সংস্কৃতির অনেক কিছুই প্রত্নতত্ত্ববিদরা গবেষণার মাধ্যমে সবাইকে জানতে সহায়তা করেন। প্রত্নতাত্ত্বিক এসব আবিষ্কারের বেশিরভাগই রহস্যময়। তেমনই একটি রহস্যময় প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার নিয়ে এই লেখা।
১৯৯৩ সালে রাশিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক নাটালিয়া পোলোসমাক ও তার দল চীনের সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে আলতাই পর্বতমালায় অবস্থিত উকোক মালভূমিতে একটি প্রাচীন সমাধি খনন করেন। এ সমাধি থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা রহস্যময় এক মমি আবিষ্কার করেন। এটি উকোকের রাজকুমারী, আলতাই রাজকুমারী, ‘আইস প্রিন্সেস’ নামেও পরিচিত। এটি মূলত খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর একজন মহিলার মমি। ২০ শতকের শেষের দিকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাশিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘আইস প্রিন্সেস’।
সমাধিটি শীতপ্রধান অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় মমিটি বরফে আচ্ছাদিত ছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বরফ গলানোর সঙ্গে সঙ্গে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সমাধিটি উচ্চ শ্রেণির কোনো ব্যক্তির। সমাধিটি কোনো রাজকুমারীর বলে ধরে নেয়া হয়েছিল। সে কারণেই উকোকের রাজকুমারী, আলতাই রাজকুমারী বা ‘আইস প্রিন্সেস’ নামে এটি পরিচিত হয়। রহস্যময় এ মমিটি সজ্জিত ছয়টি ঘোড়া বেষ্টিত ছিল এবং শক্ত লার্চ কাঠের তৈরি একটি কাঠের কফিনে সমাহিত করা হয়েছিল। তবে কী কারণে ছয়টি ঘোড়া বেষ্টিত ছিল তা জানা যায়নি।
সমাধিটি একজন যুবতী মেয়ের ছিল। মমিটি এত ভালোভাবে সংরক্ষিত যে, তার ট্যাটুগুলো এখনও দেখা যায়। কিন্তু তিনি কে ছিলেন এবং কেন তাকে এমনভাবে সমাধিস্থ করা হয়েছিল? সে বিষয়ে অনেক কিছুই জানা যায়নি।
সমাধিস্থ করা মেয়েটির দেহ সাবধানে সুগন্ধি বস্তুদ্বারা সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তাকে সমাধিতে এমনভাবে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল যেন সে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। তার মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হলেও একটি পরচুলা এবং লম্বা হ্যাট পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার উচ্চতা ছিল ১৬৭ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ৪ ইঞ্চি)। তার ফ্যাকাশে ত্বকে উপজাতীয় ট্যাটুতে প্রাণীর রূপগুলো এখনও স্পষ্টভাবে দেখা যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন যে, সমাধিটি পাজিরিক সংস্কৃতির অন্তর্গত।
এই অঞ্চলের অনেক পাজিরিক সমাধি ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে প্লাবিত হয়েছিল, যা তখন বরফে জমে ছিল। বরফের কারণে অনেক ধ্বংসাবশেষ অক্ষত ছিল। মৃতদেহটি মৃত্যুর অন্তত তিন মাস পর দাফন করা হয়েছিল বলে মনে করেন গবেষকরা। প্রত্নতত্ত্ববিদরা সমাধিটি প্রথমে মনে করেছিলেন, সমাধিটি উচ্চ শ্রেণির কোনো ব্যক্তির নয়। তার সমাধিটি এমনভাবে সজ্জিত করা হয়েছে যা, পাজিরিক সমাজের মধ্যম স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি একই এলাকায় পাওয়া পাজিরিক সম্ভ্রান্তদের সমাধির মতো বড় বা সমৃদ্ধভাবে সজ্জিত ছিল না।
এই অঞ্চলের উচ্চ শ্রেণির ব্যক্তিদের সমাধিগুলো ‘আইস প্রিন্সেস’ এর সমাধি থেকে কিছুটা দূরে পাওয়া গেছে যা, তার মৃত্যুর পরে তার দৃশ্যত আনুষ্ঠানিক ভূমিকার সাথে মিলিত, একটি চমকপ্রদ সম্ভাবনার দিকের ইঙ্গিত করে। মমির মেয়েটিকে যেভাবে সমাধিস্থ করা হয়েছে তাতে মনে হয় সে ব্রহ্মচর্য পালন করতো। গবেষকরা এটাও মনে করেন যে, ‘আইস প্রিন্সেস’ আসলে একজন বৈদ্য বা ওঝা ছিল।
‘আইস প্রিন্সেস’ এর মৃত্যুর কারণ দীর্ঘদিন অজানা ছিল। ২০১৪ সালে, গবেষকরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে স্তন ক্যান্সার। এছাড়া তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এই আঘাতগুলো গুরুতর ছিল না। গবেষকরা প্রাথমিকভাবে ধরে নিয়েছিলেন যে, দেহটি মঙ্গোলিয়ান বংশোদ্ভূত। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকরা দেখাতে সক্ষম হন, ‘আইস প্রিন্সেস’ এর দেহটি আসলে ককেশীয়। মস্কোর ফরেনসিক ভাস্কর তানিয়া বালুয়েভা তার মুখের পুনর্গঠনে এটি নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র: হিস্টোরিক-মিস্ট্রিয়াস
আপনার মতামত লিখুন :