মঞ্জুরে খোদা টরিক: গত মাসে ভারতের জাতির পিতা গান্ধীজির ১৫০তম জন্মজয়ন্তী ছিলো। তার জন্মদিন তার জন্মভূমি ভারত ও গুজরাটে নীরবেই চলে গেলো। এই গুজরাটে নরেন্দ মোদিও জন্মগ্রহণ করেছেন, যিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু কেন এমনটা হলো? ভারতে আজকে গান্ধীজির খুনি নাথুরাম গর্ডসকে নিয়ে যতোটা মাতামাতি-পূজা-অর্চনা, ভক্তি-শ্রদ্ধা, প্রার্থনা হয়, তার সামান্যই হচ্ছে গান্ধীকে নিয়ে। ভারতের ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবলয়ের বিজেপি, আরএসএস, হিন্দুসভার অনেক নেতা এখন প্রকাশ্যেই গর্ডসের প্রশংসা করছেন, তাকে দেশপ্রেমিক বলছেন। তার অনুষ্ঠান করছেন, সেখানে যোগ দিচ্ছেন ইত্যাদি। এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা কোনো সামাজিক সংকট ছিলো না ছিলো না। এটা ছিলো একটি রাজনৈতিক সংকট এবং যে সংকট তৈরি করেছেন রাজনীতিকরা। সেটা তাদের আরোপিত, তাদেরই বিস্তার ও প্রতিষ্ঠা। রাজনীতি বিভক্তিতে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে কৃত্রিমভাবে টেনে আনা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা তাদের স্বার্থে-সুবিধায় সে কাজটি করেছেন। দেশভাগে জনগণের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের বিনিময় না করে- দেশের বিভক্তি ছিলো এক মহাগণপ্রতারণা।
বিভক্তির আলাপ-আলোচনা ও দাবি যখন প্রবল হয় তখন গান্ধীজি বলেছিলেন, দেশ ভাগ করতে হলে তার মৃত দেহের ওপর করতে হবে। কিন্তু সে কাজটি যখন হয়ে গেলো তিনি চুপ ছিলেন। অন্যদের চাওয়ার কথা বলে নিজের নীরবতাকে গ্রহণযোগ্য করলেন। কিন্তু তিনি কি তার দায় এড়াতে পারেন? অন্যান্য রাজনীতিকদের সঙ্গে তিনিও ছিলেন সেই গণপ্রতারকদের একজন। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন, কিন্তু দেশভাগের সময় অন্য নেতাদের ওপর দায় চাপালেও নিজে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেননি, বাধা দেননি। তখন কোনো সত্যাগ্রহ ছিলো না। তাঁর ও তাদের সেই ঐতিহাসিক ভুলের মূল্য এখনো সব জাতিকে দিতে হচ্ছে। শুধু জাতিকে নয় তাঁকেও দিতে হচ্ছে। যে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি দেশ বিভাগের মাধ্যমে শুরু হয়েছিলো তা তাঁকে ছাড়েনি। তিনি নিজেই আজ তার করুণ পরিণতির শিকার।
গান্ধীর খুনিদের (১০৪৯ সালে) আইনী প্রক্রিয়ায় ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সেই খুনিরা আজ তাদের সে অপকর্মের জন্য প্রকাশ্যে প্রশংসিত, নন্দিত ও পুজিত। সময়ের ব্যবধানে সেটা আজ নিন্দা, ঘৃণা, অন্যায় ও আইন বিরুদ্ধ কোনো কাজ নয়। তারা আজ নায়ক। তার সে কর্মের প্রসংশা করাতো মানে বিচারকেই প্রত্যাখ্যান করা, প্রশ্নবিদ্ধ করা। উপমহাদের রাজনীতিতে নেতাদের সবচেয়ে বড় ভুল ধর্মের রাজনীতির বিষবৃক্ষ রোপণ ও একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতা। যে ধারা এখন উপমহাদেশে আরও প্রবল ও অপ্রতিরোধ্য হয়েছে। যে কারণে খুনিদের অনুষ্ঠানের শোরগোলে চাপা পড়ে যায় ভারতের জাতির পিতার জন্মজয়ন্তী।
বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, গান্ধীজিকে নিয়ে ভারতে আর কোনো হৈচৈ নেই, গান্ধী কি এখন তবে বেঁচে থাকবেন, ভারতে দুই হাজার টাকার নোটে, আর কিছু মানুষের কোটে? ভারতে গান্ধীকে নিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ-বিভক্তি দৃশমান নয়। যে শাসকই ক্ষমতায় আসুক তাকে নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। তাঁর প্রতিকৃতি কখনো সরকারি দফতর থেকে সরানো হয়নি। সেই ভারতে এমন অবস্থা হতে পারলে- বাংলাদেশ কি তার থেকে অনেক দূরে? এখানেও রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে বাড়ছে তাতে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। শাসক সমাজের অন্তর্গত চিত্র-চরিত্র বুঝতে অক্ষম। ক্ষমতার দম্ভ-অহংকার তাদের অন্ধ করেছে। একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ-রাজনীতি গড়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতার চরম মূল্য দিতে হবে একদিন। এখানেও জাতীয় নেতার খুনিদের একদা নায়কের সম্মান দেওয়া হয়েছিলো, মিলাদ-মোনাজাত হয়েছিলো। তাদের ফাঁসিতে ঝুলানোই কি শেষ কথা? ভারতে গান্ধীর খুনিদের তাহলে রাজনীতিতে প্রভাব বাড়ে কীভাবে? আমাদের দেশে যদি একটি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পরিবেশ গড়ে তোলা না যায় তাহলে বিপদ এখানেও আসন্ন। লেখক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :