প্রভাষ আমিন
আশির দশকে আন্দোলনটা স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে ছিলো বটে, তবে এখন আর আমি এরশাদ বা জাতীয় পার্টিকে অত দোষ দিই না। এরশাদ একজন ব্যক্তিমাত্র। পতনের পর নানান কিছু করেছেন বটে, তবে পতিত স্বৈরাচার এরশাদ ক্লাউনের বেশি কিছু ছিলেন না। জাতীয় পার্টি এখনো বিরোধী দল, তবে গৃহপালিত। এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করতে, জোট করতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাদের কেমন লাগে জানি না, দেখতে আমাদের খুব লজ্জা লাগে। তেমন একটি দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। সম্ভবত ১৯৯৯ সাল। চারদলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক হবে ২৯ মিন্টো রোডে বিরোধীদলীয় নেতার সরকারি বাসভবনে। ভোরের কাগজের রিপোর্টার হিসেবে আমার তখন সেখানে অ্যাসাইনমেন্ট ছিলো। একে একে নেতারা আসছেন। এরশাদের গাড়ি আসছে শুনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য। সবাই অপেক্ষা করছেন গাড়ি বারান্দায়। হঠাৎ আমানউল্লাহ আমান মাঝের ফুলের বাগান পায়েদলে ছুটে গেলেন এরশাদকে মূল ফটকেই রিসিভ করতে। তারপর স্বৈরাচার এরশাদের গাড়ির সঙ্গে হেঁটে আসেন স্বৈরাচারবিরোধী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহŸায়ক আমানউল্লাহ আমান। আমান ভাই হয়তো জানতেও পারবেন না, শুধু বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবনের ফুল বাগান নয়, তিনি সেদিন তছনছ করে দিয়েছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে তার সঙ্গে পা মেলানো এক কর্মীর হৃদয়ও। এরপর এমন অশ্লীল দৃশ্য আরও অনেক দেখেছি।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এরশাদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের সবচেয়ে জরুরি মামলাটি করেছিলেন। এরশাদের আরও অনেক মামলার মতো সে মামলাও কোনো পরিণতি পায়নি। বরং বাদী ইনু আর বিবাদী এরশাদ একসময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট করেছেন। রাজনীতিতে সবচেয়ে অশ্লীল বাক্য হলো- রাজনীতিতে আসলেই শেষ কথা বলে কিছু নেই। আমার দুঃখ এতো রক্ত, এতো সংগ্রাম করেও আমরা পূর্ণ গণতন্ত্রের স্বাদ পাইনি। নূর হোসেন জীবন দিয়েছেন ৩৪ বছর আগে। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। নূর হোসেনের বুকে-পিঠের দুটি ¯েøাগানই ভুল বানানে লেখা। আমরা কি তাহলে ভুল আন্দোলনে অপচয় করেছি আমাদের উজ্জ্বল যৌবন? যতোবার প্রশ্ন করি, ততোবারই জবাব পাই না। জাতীয় পার্টি যখন আজ ১০ নভেম্বর পালন করে ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে, তখন বুঝি গণতন্ত্র আজও মুক্তির জন্য ডানা ঝাঁপটায়। জুরাইন কবরস্থানে শুয়ে থাকা নূর হোসেনের আত্মা কি একটু কষ্ট পায় না?
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আমাদের যৌবনকে মহিমান্বিত করেছে। রাজনীতিবিদদের আপোসের চোরাবালিতে হয়তো হারাতে বসেছে আমাদের মহৎ অর্জন। কিন্তু তাতে অর্জনের মাহাত্ম্য হয় না। খেটে খাওয়া যুবক নূর হোসেনের কাছে বানানটা মুখ্য ছিলো না, মুখ্য ছিলো গণতন্ত্রের মুক্তি। নূর হোসেন দিবসে ভোটাধিকারের জন্য আমাদের আকাক্সক্ষা আরও তীব্র হয়, গণতন্ত্রের জন্য আমাদের তৃষ্ণা আরও বাড়ে। ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ এই ¯েøাগান এখনো প্রাসঙ্গিক মনে হয়। এটা মানতেই হবে, গত একযুগে বাংলাদেশে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ চমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। আশির দশকে আমরা ভাবিইনি, বাংলাদেশ আজকের জায়গায় পৌঁছবে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময়ে বদলে দেওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই শেখ হাসিনার, আওয়ামী লীগের। সেই আওয়ামী লীগের কাছেই আমাদের আকাক্সক্ষা, উন্নয়নের যে ধারা, তা আরও বেগবান হোক, টেকসই হোক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। গণতন্ত্র না থাকলে, মানুষের ভোটাধিকার না থাকলে সবকিছুই অর্থহীন হয়ে যায়। লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
আপনার মতামত লিখুন :