অজয় দাশগুপ্ত
পাপ পুণ্য যদি মানেন তবে এর চেয়ে বড় পাপ ইতিহাসে খুব কম। কারাগার হচ্ছে নিরাপদ স্থান। অপরাধীও যেন বেঘোরে মারা না পড়ে তাই তাদের চার দেয়ালের ভেতরে রাখার নিয়ম। সে রাতে দুনিয়ার সব সভ্যতা, নিয়ম ও আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খুলে দেওয়া হয়েছিলো জেল ফটক। কার নির্দেশে? তখন এই দুর্ভাগা দেশের গদী দখল করেছিলো আওয়ামী মীরজাফর মোশতাক। যে কিনা এই চার নেতার সহকর্মী হয়তো বন্ধুও। সেই একাত্তর থেকেই মোশতাক গুটি চালছিলো,পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার জন্য। তখন সে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার এসব ক‚ট চাল বন্ধ করার জন্য বিদেশ যাওয়াও নিষিদ্ধ হয়েছিলো। অথচ এই মোশতাকই হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর কাছের লোক। আর সে সুযোগে তাজউদ্দীনের মতো নেতাকে দূরে সরিয়ে তার নীল নকশা বাস্তবায়ন করতে বেগ পেতে হয়নি তাকে। যাদের সঙ্গে আজীবন ওঠাবসা যাদের সঙ্গে পারিবারিক পরিচয় ও আদর্শিক মিত্রতা তাদের হত্যা করার জন্য জেল ফটক খুলে দিতে বলার মতো পাপ করতে বুক কাঁপেনি তার। মূলত সে রাতেই আমাদের নৈতিকতাও ন্যূনতম বিশ^াস ভেসে গেছিলো রক্ত ধারায়।
এই চার নেতা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মূলস্তম্ভ। আজকের প্রজন্ম বিশ্বাস করতে পারবে না কতোটা সহজ ও সরল ছিলো তাঁদের জীবনযাপন। কালো ছাড়া কোনো বিলাস ছিলো না অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের, মনসুর আলী তো দেখতেই হেড টিচার, কামরুজ্জামানের ছেলেরা তখন কলকাতা রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র আর তাজউদ্দীন? ওই একটা সাদা হাফহাতা শার্ট। তিনি তখন না সরকারে না আওয়ামী লীগে। তবু তাঁরাই হলেন টার্গেট। কারণ তাঁরা ফণী বাবু, মালেক উকিল বা তাহের ঠাকুরদের মতো সরকারে যেতে রাজি ছিলেন না। জেলের পাগলা ঘণ্টা শুনে ঘাবড়ে যাওয়া কামরুজ্জামান তাজউদ্দীনকে প্রশ্ন করেছিলেন, কী হতে চলছে? শান্ত গলায় তাজউদ্দীন তাঁকে বলেছিলেন, যান অজু করে নামাজটা পড়ে নিন। এই ছিলো তাঁদের শেষ প্রার্থনা। পাকিস্তানিরা যা করেনি তাই করেছিলো পথভ্রষ্ট একদল সেনা অফিসার। জেনে অবাক হবেন না জেল হত্যার বিচারে দপ্রাপ্ত এগারো আসামির দশজন এখনো পলাতক। তবু ৩ নভেম্বর আসে, রক্ত ও শোকে জানান দেয় কাকে বলে নেতৃত্বহীন কেন আজ এই অবক্ষয়।
সরকারি দল নিয়মমাফিক ৩ নভেম্বর পালন করে। কিন্তু একটা আফসোসের জায়গা থেকেই গেলো। এই চার নেতার একাত্তরের ভ‚মিকা ভালো করে তুলে ধরেন না কেউ। বঙ্গবন্ধু তো সবার ওপরে। এ নিয়ে কারও তর্ক নেই। কিন্তু তাঁকে সমানে আনার মানে কি এই যে এই চার নেতাকেও বিস্মরণে রাখতে হবে? আজকের স্তাবকতা বেষ্টিত রাজনীতি যদি তাজউদ্দীন আহমদ সৈয়দ নজরুলদের তুলে ধরতো একাত্তেরর নয়মাস সামনে আনতো তরুণ প্রজন্ম এতোটা বিভ্রান্ত হতে পারতো না। সত্যি কথা বলতে কী এ কাজ হয়নি। হচ্ছে না, ভবিষ্যতে হবে এমনও ভাবা যায় না। এভাবেই কি অন্তরালে থেকে যাবে তাঁদের অবদান? আর এসব কারণেই নয়মাসের কাহিনিবিহীন মুক্তিযুদ্ধ কেবল চেতনার নামে আজ মাথা তুলতে পারছে না।
৩ নভেম্বর ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কিত অধ্যায়। যার অভিশাপ আমাদের সমাজকে মাফ করেনি। করেনি বলেই হানাহানি দাঙ্গা সন্ত্রাস অগণতান্ত্রিকতা যায়নি। বরং চারদিক থেকে চেপে ধরেছে। এই যে সাম্প্রদায়িকতা এই যে মারমার কাটকাটের জন্য যারা দায়ী তারা না জানে ইতিহাস না চেনে তাঁদের। সে দায়িত্ব আওয়ামী লীগ পালন করেনি। আজকে তাই চোখের জল ছাড়া আমাদের দেওয়ারও কিছু নেই। সে রাতে অভিভাবকহীন রাজনীতিই এখনকার ব্যর্থতার কাজটি করে দিয়ে গেছে। সময় থাকতে তাঁদের হত্যার বিচার আর তাঁদের পুনর্বাসন করাই আমাদের কাজের কাজ। এটাই সময়ের চাহিদা। প্রণাম চার জাতীয় নেতা। লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
আপনার মতামত লিখুন :