আনোয়ার হোসেন: [২] কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে খেতের বীজআলু পঁচে গেছে। খেত থেকে সেই বীজআলু তুলে আবার নতুন করে বপন করছেন কৃষক।
[৩] শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) সরেজমিনে দেখা গেছে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় ভরনিয়া এলাকায় কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে খেতের বীজআলু পঁচে গেছে। খেত থেকে সেই বীজআলু তুলে আবার নতুন করে বপন করছেন কৃষক।
[৪] আলু চাষের জন্য রাণীশংকৈলের বেশ খ্যাতি রয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে এখানকার পাইকারি বাজারে জাতভেদে প্রতি কেজি আলুর দাম ৬-৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে লোকসানে মুখে পড়া কৃষক-ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। তবে আলুর এই বাড়তি দাম কয় দিন টিকবে,তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে আশঙ্কাও রয়েছে।
[৫] উপজেলার মন্ডলপাড়া গ্রামের কৃষক মুন্জর হোসেন (৪৭) জানান, প্রতি বিঘা জমিতে আলু আবাদ করতে প্রায় ৯০ হাজার টাকা খরচ হয়। আর গড়ে উৎপাদন হয় ১৬০ বস্তা। ১ বস্তায় ৬০ কেজি আলু থাকে। সে হিসাবে প্রতি কেজি আলুতে উৎপাদন খরচ পড়ে ৯ টাকা ৩৭ পয়সা। এর সঙ্গে যোগ হয় বস্তা কেনা, পরিবহন ও হিমাগারে আলু সংরক্ষণের ভাড়া। সব মিলিয়ে প্রতি কেজি আলু উৎপাদনের ন্যূনতম খরচ দাঁড়ায় ১৬ টাকার ওপরে। বাজারে সেই আলু ১০ থেকে ১১ টাকা দর চলায় কৃষকের ‘মরণদশা’ হয়েছিল। এখন আলুর দাম বাড়ায় তাঁদের মনে স্বস্তি এনে দিয়েছে।
[৬] মৌসুমের শুরুতে বাজারে আলুর দাম ভালোই ছিল। তবে ধীরে ধীরে পাল্লা দিয়ে তা কমতে থাকে। লোকসানের অঙ্ক কষে অনেক কৃষক-ব্যবসায়ী হিমাগারে রাখা আলু তাই বের না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু চলতি সপ্তাহে দাম বাড়ায় হিমাগারের আলু এখন বাইরে আসা শুরু করেছে।
[৭] বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন ঠাকুরগাঁও জেলা সূত্রে জানা গেছে, অন্যবার এ সময়ের মধ্যে সাধারণত ৮০ ভাগ আলু হিমাগার থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত ৫০ ভাগ আলুও হিমাগার থেকে বের হয়নি। হিমাগারে থাকা আলুর মধ্যে ১০ শতাংশই আবার কৃষকের বীজ আলু।
[৮] হাওলাদার হিমাগারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারোয়ার বলেন, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে আলুর আগাম আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে কৃষক-ব্যবসায়ীরা হয়তো ভাবছেন, এ মৌসুমে আগাম আলু পুরোদমে বাজারে আসতে দেরি হবে। এতে তাঁরা হিমাগারে রাখা পুরোনো আলু বাজারে ছাড়ছেন ধীরগতিতে। তিনি বলেন, তাছাড়া এখন বাজারে সব ধরনের সবজির দাম বেশি। অন্যান্য সবজির দাম বেশি থাকলে আলুর দামও কিছুটা বাড়ে।
[৯] বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপের কারণে ১৮ অক্টোবর থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি, আবার কখনো প্রবলবেগে বৃষ্টি হয়। এতে খেতে রোপণ করা আগাম বীজ আলু ও রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সবজির বিকল্প হিসেবে ভোক্তারা আলুতে ঝুঁকে পড়েন। আর এতেই আলুর দাম বাড়তে শুরু করে। ১০টি হিমাগারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব জায়গায় ২১ অক্টোবর থেকেই আলুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। ২১ অক্টোবর থেকে প্রতি কেজি কার্ডিনাল-অ্যাসটেরিক্স আলু ১৩ টাকা, ডায়মন্ড সাড়ে ১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর শুক্রবার সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২১ টাকা দরে।
[১০] কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাণীশংকৈল কার্যালয়ের সূত্রমতে, ২০২০ সালের আলু মৌসুমে উপজেলায় ৩৯৫০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছিল। লক্ষমাত্রা ছিল ৩৭৪৫ হেক্টর। আলু উৎপাদন হয়েছিল ৯৯ হাজার ৪১৩ মেট্রিক টন। সে বছর বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষক-ব্যবসায়ীরা আলুতে ব্যাপক লাভ করেন। আর এতেই কৃষকেরা আলু চাষে ঝুঁকে পড়েন। চলতি বছরে কৃষকেরা ১ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করেছেন। ২০২১/২২ অর্থবছরে আবাদের লক্ষমাত্রা ৩৯৫০ হেক্টর
[১১] অন্যদিকে, আলু সংরক্ষণের জন্য সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে জেলায় ১৫টি হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারে মাত্র ১ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করার যায়। ফলে কৃষকের উৎপাদিত অধিকাংশ আলুই সংরক্ষণের বাইরে থেকে যায়। বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বাড়তি থাকায় আলুর দামে ধস নামে। সদর উপজেলার হিমাগারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর হিমাগার পর্যায়ে প্রতি বস্তা (৬০ কেজি) কার্ডিনাল-অ্যাসটেরিক্স আলু ৬০০ টাকা, ডায়মন্ড আলু ৬৬০ টাকা পর্যন্ত কেনাবেচা হচ্ছিল। সে হিসাবে প্রতি কেজি কার্ডিনাল-অ্যাসটেরিক্স আলু ১০ টাকা ও ডায়মন্ড আলু ১১ টাকায় বিক্রি হয়।
[১২] স্থানীয় সাথী হিমাগারে কথা হয় ধর্মগড় এলাকার আলুচাষি বিজয় রায়ের (৪৫) সঙ্গে। বিজয় রায় এ মৌসুমে হিমাগারে দুই হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এবার আলু হামার গলাত ফাঁস নাগাবার ধরছিল। সাত দিনের মধ্যে দাম বাড়িছে। এলা আলু বেচিয়া আসলখান উঠায়া লাভও হবা পায়।’
[১৩] কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় দেবনাথবলেন, এ এলাকার কৃষক যখন একটি ফসলে লাভ পায়, তখন অন্যরাও সেটাতেই ঝুঁকে পড়েন। গত মৌসুমে আলুর ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। সে সময় আলুর পাশাপাশি সবজিও রেকর্ড উৎপাদন হয়েছিল। তাতে হিমাগারে সংরক্ষণ করা আলুর চাহিদা কমে যায়। গত কয়েক দিনের বৃষ্টির কারণে আগাম আলু চাষ বিলম্বিত ও শীতকালীন আগাম সবজির ক্ষতি হওয়ায় বাজারে আলুর দামে প্রভাব পড়েছে। এতে চরম লোকসানের মুখে পড়া আলুচাষিদের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে দিয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :